রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবলোপন করা ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না। যদিও প্রতি বছরই অবলোপন করা ঋণ আদায়ের বড় বড় লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছে এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে, সমালোচনা করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
কোনো একজন গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার পর তিনি তা পরিশোধ করছেন না। এভাবে ঋণটি খেলাপি ঋণের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মন্দ ও ক্ষতিজনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পরে ব্যাংক বাধ্য হয়ে ওই ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রেখে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনা, মামলা ইত্যাদি করার পর যখন ব্যাংক বুঝতে পারে ঋণ আদায়ের সব ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তখন মন্দ মানের এই খেলাপি ঋণকে সাধারণ হিসাব থেকে সরিয়ে আলাদা করে হিসাব রাখে। সাধারণ হিসাব থেকে এই সরিয়ে রাখা বা আলাদা রাখাকে অবলোপন বলা হয়।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) অবলোপন করা ঋণ থেকে ২১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়েছিল। কিন্তু জুলাই থেকে গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি মাত্র ৭১ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে। একইভাবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ঠিক করেছিল চলতি অর্থবছরে ১৫৩ কোটি টাকা আদায় করবে।
এই ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ৮১ লাখ টাকা। আর বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ২৬৩ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে চার মাসে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি।
এছাড়া কর্মসংস্থান ব্যাংক ১৪ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে ১৯ লাখ। এক লাখ টাকা আদায় করেছে আনসার ভিডিপি ব্যাংক, যার আদায়ের লক্ষ্য ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
সম্প্রতি বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এক সভা করে। ওই সভায় এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অনুযায়ী ঋণ আদায় এবং বিভিন্ন ধরনের মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ উদ্যোগের অভাবেই অবলোপন করা ঋণ আদায় এবং মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে মনে করছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা।
এদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে রিট মামলা ও অর্থঋণ মামলার পাহাড় জমেছে। চলতি অর্থবছরে বিকেবি ১০৪টি, রাকার ৪০টি, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ১৬টি, আইসিবি ২৪টি রিট মামলার নিষ্পত্তির লক্ষ্য নিয়েছে। কিন্তু গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে এসব প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে অর্থঋণ মামলার নিষ্পত্তির অবস্থা আরও খারাপ। বিকেবি ১ হাজার ৩৪০টি, রাকাব ৫ হাজার ৪৯৪টি, কর্মসংস্থান ব্যাংক ১৯৯টি ও আইসিবি ১০০টি অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্য নিয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠান মোট ২৯৪টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে, যার মধ্যে ২৫৭টি রাকাবের। প্রতিষ্ঠানগুলোর এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এদিকে এই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্য অনুযায়ী ঋণ বিতরণও করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরে আইসিবি ১ হাজার ২১৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নিয়েছে, গত সাড়ে চার মাসে বিতরণ করেছে ১৯০ কোটি টাকা।
বিকেবি ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে বিতরণ করেছে ১ হাজার ২২০ কোটি, রাকাব ২ হাজার ২০০ কোটির বিপরীতে ৩৬৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
অন্যদিকে খেলাপি এবং খেলাপি নয় এমন ঋণ আদায়েও অগ্রগতি কম। বিকেবি পুরো অর্থবছরে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে গত সাড়ে চার মাসে মাত্র ৯০২ কোটি টাকা আদায় করেছে। ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে ৩৯৪ কোটি টাকা আদায় করেছে রাকাব। আইসিবি ২৩৭ কোটি টাকা আদায় করেছে ১ হাজার ৩০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে।
গত সাড়ে চার মাসে আনসার ভিডিপি ব্যাংক ১৭৩ কোটি টাকা, কর্মসংস্থান ব্যাংক ৩২৯ কোটি টাকা, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ১১৩ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।