আমকে ফলের রাজা বলা হয়। বাংলাদেশে আমই হচ্ছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফল। এ ফলটি দেশের সব জায়গাতেই কমবেশি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আম প্রধান অর্থকরী ফসল। কিছুদিনের মধ্যেই আম গাছগুলো নতুন মুকুলে ভরে উঠবে।
আমের মুকুল আসা ও ফল ধরার সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়ার জন্য এ সময় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য। আম চাষ করতে গিয়ে আমচাষীরা যেসব সমস্যায় পড়েন তার মধ্যে আমের গুটি ঝরা অন্যতম। আমগাছে গুটি আসার পর নানা কারণে গুটি ঝরে যায়। এসবের কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলোঃ-
প্রাকৃতিক কারণঃ
সাধারণত আমগাছে প্রতি মুকুলে এক হাজার থেকে ছয় হাজার পর্যন্ত পুরুষ ও স্ত্রী ফুল থাকে। তার মধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রতি থোকায় জাতভেদে এক থেকে ৩০টি আমের গুটি ধরতে দেখা যায়। গুটি আসার ২৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে প্রতি থোকায় মাত্র এক থেকে দুটি গুটি থাকে। বাকি গুটি প্রাকৃতিক বা অভ্যন্তরীণ কারণে ঝরে যায়। তবে কোনো কোনো মুকুলে কদাচিৎ চার থেকে পাঁচটি আম ধরতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আমের আকার ছোট হয়।
প্রতিকার/ করণীয়ঃ অতিরিক্ত গুটি ঝরে না পড়লে আমের আকার ছোট হয় এবং আমের গুণগত মান ও ফলন কমে যায়। প্রতিটি মুকুলে একটি করে গুটি থাকলে সে বছর আমের বাম্পার ফলন হয়। তবে প্রতি মুকুলে আমের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ফুল ফোটার ১০ ও ২০ দিন পর দুইবার ১০ লিটার পানিতে ৬ গ্রাম হারে বোরিক এসিড স্প্র্রে করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। আবার, ফুল ফোটা অবস্থায় জিবেরেলিক এসিড প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম হারে স্প্রে করলে আমের গুটি ঝরা কমে যায়।
মাটিতে রসের অভাব হলেঃ
মাটিতে রসের অভাব হলেও আমের গুটি ঝরে যায়। আমের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাটিতে রসের অভাব দেখা দেয়। মাটিতে রসের অভাব হলে আমের বোঁটায় তাড়াতাড়ি নির্মোচন স্তর গঠিত হয়। ফলে আমের গুটি ঝরে যায়।
প্রতিকার/ করণীয়ঃ মাটিতে রসের অভাবে আমের গুটি ঝরে গেলে গাছের চারপাশে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। আমের গুটি মটরদানার মতো হলেই প্রথমে একবার গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচ দেয়ার পর থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়া পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। সেচের পাশাপাশি হরমোন প্রয়োগ করেও আমের গুটি ঝরা কমানো যায়। যেমন, আমের গুটি মটরদানার মতো হলে প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার অথবা প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে দুই মিলিলিটার হারে প্লানোফিক্স হরমোন পানিতে মিশিয়ে আমের গুটিতে স্প্র্রে করলে গুটি ঝরা কমে যায়।
পোকার আক্রমণ হলেঃ
গুটি আসার পর প্রাথমিক পর্যায়ে আমের গুটিতে হপার পোকার আক্রমণ হতে পারে। এ পোকার আক্রমণে ২০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত আমের উৎপাদন কমে যেতে পারে। আম গাছে মুকুল আসার সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যেতে পারে। এ পোকার পূর্ণবয়স্ক মথ ও কীড়া গুটির রস শোষণ করে খায়, ফলে আমের গুটি শুকিয়ে ঝরে যায়। আমের মুকুল আসার পরপরই হপার পোকার আক্রমণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মুকুলের ফুল শুকিয়ে যায় এবং কোনো ফল ধরে না। এ পোকা যখন মুকুলের রস চুষতে থাকে তখন এদের মলদ্বার দিয়ে প্রচুর আঠালো রস নিঃসরণ হয়। এ রস মুকুলের ফুল ও পাতায় আটকে যায়। এতে গুটি মোল্ড নামক এক প্রকার ছত্রাক জন্মে এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে পাতার উপরিভাগ ছেয়ে ফেলে। ফলে পাতা কালো দেখায়। সবুজ পাতা কালো আস্তরণে ঢাকা থাকে বিধায় সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে গাছ দুর্বল হয় এবং ফলন কমে যায়।
প্রতিকার/ করণীয়ঃ আমবাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আগাছামুক্ত ও খোলামেলা অবস্থায় রাখতে হবে। মরা ডালপালা ছেঁটে ফেলতে হবে। হপার পোকা থেকে আমের গুটি রক্ষার জন্য দুইবার কীটনাশক স্প্র্রে করতে হবে। প্রথমবার আমের মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বে এবং দ্বিতীয়বার আমের গুটি মটরদানার মতো হলে কীটনাশক পানিতে মিশিয়ে গুটিতে স্প্র্রে করতে হবে।
কীটনাশকের মধ্যে সাইপরমেথ্রিন ১০ ইসি (রিপকর্ড, ফেনম, বাসাড্রিন) বা ল্যামডা সাই হ্যালাথ্রিন ২.৫ ইসি বা ফেন ভেলারেট ২০ ইসি গ্রুপের যেকোনো একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রোগের আক্রমণ হলেঃ
সাধারণত মাঘ-ফাল্গুনে আম গাছে মুকুল-ফুল-গুটি আসে। আমের এ অবস্থায় ছত্রাকজনিত নানা রোগের আক্রমণে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে। এসব ছত্রাকজনিত রোগের পাউডারি মিলডিউ অন্যতম। আক্রান্ত অংশে পাউডারের গুঁড়ার মতো এক প্রকার জিনিস দেখা যায়। রোগের ব্যাপক অবস্থায় আক্রান্ত অংশ সাদা পাউডারে মুকুল ঢেকে যায় এবং আমের গুটি ঝরে পড়ে। এছাড়াও অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণেও আমের গুটি ঝরে যেতে পারে। মুকুল বা ফুল এ রোগে আক্রান্ত হলে তা কালো হয়ে ঝরে পড়ে। গুটি বা ছোট অবস্থায় আক্রান্ত হলে আমের গায়ে ধূসর বাদামি বা কালো দাগ পড়ে। বেশি আক্রান্ত হলে এগুলোও ঝরে পড়ে। আমের মুকুলে এ রোগের আক্রমণ হলে গাছের সব মুকুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
পাওডারী মিলডিও রোগের জন্য ফুল আসার আগে একবার এবং ফুল ধরার পর একবার সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন কুমুলাস, ম্যাকসালফার, থিওভিট, রনভিট ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়। অ্যানথ্রাকনোজ রোগের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি প্রোপিকনাজল (টিল্ট) বা ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম (ব্যাভিস্টিন) বা ২ গ্রাম ডাইথেন এম৪৫ মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
সহযোগী অধ্যাপক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।