আলোচিত ‘ব্যাংকিং কমিশন’ গঠনের রূপরেখা প্রণয়নের কোনো অগ্রগতি নেই। গত মাসে ব্যাংক-আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দুরবস্থা দেখভালে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সেই নির্দেশনার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ করার কথা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগের তথ্য পাওয়া যায়নি। সূত্র জানায়, ব্যাংকিং কমিশন গঠনের রূপরেখা প্রণয়নের বিষয়ে উপর থেকে কোনো দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী
পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে আমার জানা নাই। তবে এর মাঝে এক অংকে সুদ হার নামিয়ে আনতে কাজ করা হয়েছে। আর সেটা নিয়েই ব্যস্ত আছি। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে তার আলোকেই বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করবে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতের অনিয়ম বন্ধের পাশাপাশি এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি তোলা হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। কমিশন গঠনে অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান বিশ্লেষকরা। অবশ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর পর গত মাসে আদালত আবারও কমিশন গঠনের আদেশ দেন। কিন্তু আদেশের পর আর কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেশের খাদ্য উৎপাদন, শিল্পায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে শুরু থেকে অদক্ষতা ও অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক গ্রুপ ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঘটনা সমালোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ ছাড়া সুশাসনের অভাবে ঋণগ্রহীতা নির্বাচন ও ঋণ প্রস্তাবের মূল্যায়নে অনিয়ম, ঋণ বিতরণ ও আদায়ে দুর্নীতি ও অনীহা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা প্রতিনিয়তই আলোচনা হচ্ছে। অন্যদিকে উন্নত গ্রাহক সেবা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুপরিচিত বেসরকারি ব্যাংকগুলো। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ দেয়া এবং এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে এক ধরনের স্বজনপ্রীতি প্রতিষ্ঠার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করে। ফলে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সার্বিক কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের তাগিদ দেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য গত কয়েক বছর ধরে আলাদা কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করে আসছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া কমিশন প্রতিষ্ঠা করেও কোনো লাভ হবে না।
অর্থনীতিবিদরা জানান, শুধু কমিশন গঠন করলেই হবে না, এখানে যারা নিযুক্ত হবেন তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কমিশনে কোনো প্রশাসনিক জটিলতা থাকলে ব্যাহত হবে কার্যক্রম। সেই সঙ্গে লোকবল হতে হবে যোগ্য ও দক্ষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশনে এমন লোক দিতে হবে, যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। পাশাপাশি যাদের ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞতা আছে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারা সমস্যা নির্ণয় করবে। বিশেষ করে দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপি থেকে কিভাবে বেড়িয়ে আসা যায়, তা চিহ্নত করবে। আশা করি এসব কাজ করলে কমিশন ফলপ্রসূ হবে।
গত মাসে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুরবস্থা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৯ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। কমিটিতে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের রাখতে বলা হয়েছে। ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন ও দুর্নীতির বিষয়ে এ কমিটি যে সব সুপারিশ করবে তা অনুসরণ করতে বলেছে আদালত।
গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি মানবাধিকার সংগঠন এইচআরপিবির করা এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট এক আদেশে ঋণখেলাপির তালিকা দাখিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে রুল জারি করেন। রুলে আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না ও এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরে গত ২৪শে জুন বাংলাদেশ ব্যাংক সিলগালা করে ঋণখেলাপির তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করে। এর মধ্যে গত ১৬ই মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়। এরপর গত ২১শে মে ওই সার্কুলারের ওপর ২৪শে জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজার রাখার জন্য আদেশ দেন আদালত। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২রা জুলাই আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত ৮ই জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। পরে ৮ই জুলাই এ স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো দুই মাস বাড়ায় হাইকোর্ট। তবে যারা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের সুবিধা নেবেন তারা নতুন করে ঋণ নিতে পারবেন না। এছাড়া বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন কোর্টে এ রিট মামলা শুনানি করতে বলেন। তার ধারাবাহিকতায় রুলের শুনানি শেষে গত ৪ঠা নভেম্বর আদালত ওই রায় দেন।