Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভূতের বাড়ি কাহিনী

ভূতের বাড়ি কাহিনী

ছবি সংগৃহীত।

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

খুলনা: ছোটবেলায় সবাই কম বেশি কত রকমের ভূতের গল্প শুনেছি। ভূত না দেখেও গল্প শুনে ভয় পেয়েছি। নানা ধরনের গা ছমছম করা ভূতের গল্প ছিল সেগুলো। কেউ কেউ মনে করে ভূতের অস্তিত্ব নেহাত একটি কাল্পনিক ব্যাপার। ভূত দেখার ঘটনা মন বা চোখের বিভ্রম ছাড়া কিছুই না। যাই হোক আসুন, আজ শোনা যাক খুলনার ভূতের বাড়ির গল্প। একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে টিকে আছে জল্লাদখানা ভূতের বাড়িটি।

একজন সদস্যের আত্মহত্যার কারণে পরিবারের বাকি সদস্যরা বাড়িটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। খুলনা শহরবাসীর কাছে পরিত্যক্ত এই বাড়িটি ‘ভূতের বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়। অনেক পরে ওই বাড়ির দক্ষিণ দিকের দোতলা ভবনটিতে আনসার বাহিনীর অফিস করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের সহায়তা করার জন্য জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ একাত্তরের মে মাসে এই বাড়িতেই ৯৬ জনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। রাজাকার নামটিও তার দেওয়া। এটাই একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প। পরে ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন।

এই রাজাকাররাই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগী হিসেবে হত্যা-নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ করে।

খুলনা মহানগরীর রূপসা বাস স্ট্যান্ড থেকে খান জাহান আলী সড়ক ধরে টুটপাড়া কবর স্থানের ঠিক আগে আনসার ক্যাম্প। সেই আনসার ক্যাম্পের একটি ফলকে লেখা এটি। যেটি ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’র পক্ষে উদ্বোধন করেন প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন।

খুলনার ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক এএইচএম জামাল উদ্দিন জানান, কুখ্যাত দিক দিয়ে ভূতের বাড়িটি এক নম্বরে রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয় তার যাত্রা শুরু হয় এই বাড়ি থেকে। আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক ও পাকিস্তান আমলে পিরোজপুরের এমপি মাওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে এটা গঠন করা হয়। রাজাকার নামটিও তার দেওয়া। এটাই একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প। বর্তমানে আনসার ও ভিডিপি কমান্ডারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়িটি। এ বাড়ির ইতিহাস নিয়ে নানারকম জনশ্রুতিও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ বাড়িতে নয়টি নির্যাতন সেল তৈরি করা হয়েছিল।

২০১৫ সালে আনসার ও ভিডিপি কমান্ড্যান্টের কার্যালয়ের সীমানার বাইরে খুলনায় একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্পের পরিচিতিমূলক ফলক স্থাপন করা হয়।

এছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে, নাটোরের দীঘাপতিয়া রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম ১৭১৪ সালে খুলনা ও যশোরের অনেক জমি দখল করেন। আর রাজা দয়ারামের বোনের মেয়ে ছিলেন শীলা। শীলা খুবই সুন্দরী ছিলেন। তার মামাবাড়িতে অবস্থানকালে রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত যাত্রা দেখতে গিয়ে অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েন নিশিকান্ত নামের এক যাত্রাশিল্পীর। গোপনে তারা অভিসারে বের হতেন। এমনই চলতে থাকে। একদিন তারা পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান দয়ারামের কর্মচারীর কাছে।

বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে দায়ারাম শীলাকে বিয়ে দেন নিধুরাম নামে এক যুবকের সঙ্গে। একপর্যায় তাদের খুলনায় পাঠিয়ে দেন এবং আশ্রয় হয় এই বাড়িতে। শীলা এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। নিধুরামকে কখনও স্পর্শও করতে দেননি। একসময়ে শীলা আত্মহত্যা করেন। একই সময় নিধুরামও। সেই থেকে কখনো নারীকণ্ঠে হাসির শব্দ, আবার কখনও ছায়ামূর্তি দেখা যায় এ বাড়িতে। আর এখান থেকেই ভৌতিক গল্পের শুরু।
আবার কারো কারো মতে, বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক দীননাথ সিংহ। তিনি ছিলেন কুখ্যাত নীলকর উইলিয়াম রেনির অন্যতম সহযোগী। পাকিস্তান আমলে জনৈক মোক্তার এ বাড়িতে বসবাস করতে আসেন। তার এক ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়িতে মারা যান। এরপর গোলাম জব্বার নামের এক ডাক্তার এ বাড়িতে বাস করতে এলে তার এক চাকরও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সাধারণ লোকের ধারণা, এগুলো সব নাকি ভূতের কাজ। এ বাড়িটিতে এতো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে ভবনটি ভীতিকর ও রহস্যময়।
একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে টিকে থাকা জল্লাদখানা ‘ভূতের বাড়ি’র অবস্থা এখন বেশ শোচনীয়। দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না হওয়ায় এটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শত শত বছরের প্রাচীন ভূতের বাড়ির এ ভবনে দীর্ঘদিন থেকে বেড়ে ওঠছে বিশাল বিশাল বটবৃক্ষ। বট বৃক্ষের শিকড় বড় হয়ে দেয়ালে ফাটল ধরাচ্ছে। ফলে ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে ভবনটি। ভগ্ন পরিত্যক্ত কোলাহলমুক্ত বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই যে কারো গা ছমছম করবে। অনেকটা বন-জঙ্গল পরিপূর্ণ ভৌতিক পরিবেশ। ইট সুরকির দালান থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। কোথাও কোথাও খসে পড়েছে দেয়ালের ইটও। ভগ্ন দশাগ্রস্ত, ভবনটিতে এখন আর কেউ বাস করে না।

ভূতের উপদ্রব আছে কিনা:

এই ডিজিটাল যুগে ভূত-প্রেত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। অথচ লোকমুখে এই বাড়িটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ভূতের বাড়ি নামে পরিচিত। এখানে বসবাসকারী আনসার ক্যাম্পের সদস্যরা জানান, তারা কখনো ভূত দেখেননি। তবে তাদের অনেকের একটু ভয় হয় ভবনের মধ্যে উঠতে। বিশেষ করে রাতের বেলায়।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি খুলনার আহ্বায়ক ডা. বাহারুল আলম বলেন, অনেক স্মৃতি, আর কলঙ্কের সাক্ষী এই ভূতের বাড়ি। সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই এই বাড়িটি সংরক্ষণ করে এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করা হোক।