খোন্দকার মোহিতুল ইসলাম ( রঞ্জু )
জহিরুল আলম। ষাট ও সত্তরের দশকের ডাকসাঁইটে সাংবাদিক।আমি তাঁর কাছে কাজ শিখেছি। সম্পর্কটা ছিল গুরু-শিষ্যের। “যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায় / তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়’।
আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর চাকুরি খুঁজছি। আমার একমাত্র পুঁজি ছোটদের পাতায় লেখালেখির অভ্যাস। সে লেখাগুলো কেউ যদি দেখতে চান, সেজন্য একটা খাতা বানিয়েছি। রেজিস্টার খাতার পাতায় পাতায় পেস্ট করে লেখাগুলো লাগিয়েছি। তাতে হাতে লিখে দিয়েছি পত্রিকার নাম ও প্রকাশের তারিখ। তখন মুকুলের মাহফিল, সাত ভাই চম্পা, কচিকাঁচার আসর ও খেলাঘর ছিল জনপ্রিয় শিশুপাতা।
যা হোক, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার সাথেসাথে দৈনিক পয়গাম পত্রিকায় শিক্ষানবীশ রিপোর্টার হিসেবে আমার জব হয়ে গেল। বেতন ধার্য হলো একশ সাঁইত্রিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা। এই টাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পড়াশুনার খরচ যোগানোর সংস্থান হলো্।
যা বলছিলাম, দৈনিক পয়গামে চীফ রিপোর্টার ছিলেন জহিরুল আলম। সেসময়ের সেরা রিপোর্টারদের মধ্যে অন্যতম। আর আমি সাংবাদিকতার অ আ ক খ-কিছুই জানি না। সেসময় যাদের কাছে কাজ শিখতে হতো–তাদের বকা খেতে হতো। বাংলা পত্রিকায় ইংরেজি স্লাগ অনুবাদ করতে হতো। তখন ইংরেজির বড্ড প্রভাব ছিল।
একদিনের কথা বলি: আমাকে বলা হলো: আজ আখেরি চাহার শোম্বা-এর উপর একটি রিপোর্ট বানাও। কিন্তু আখেরি চাহার শোম্বা খায় না মাথায় দেয়-আমি জানি না। কী করব? তখন তো আর গুগল সার্চ দেওয়ার প্রযুক্তির কথা ভাবাও যেত না।
চালু পত্রিকার অন্যতম ছিল দৈনিক আজাদ। ভাবলাম, চুপচাপ দৈনিক আজাদে ফোন করে বিষয়টা জেনে নি। তো-ফোন করলাম। আজাদের রিপোর্টিং টিমের কোনো এক সিনিয়র সাংবাদিক ধরলেন। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সালাম দিলাম। বললাম: আখেরি চাহার শোম্বা সম্পর্কে আমাকে যদি কিছু বলতেন। তিনি আমার নাম জানতে চাইলেন। শুনে চিৎকার করে বললেন, শালা-মুসলমানের বাচ্চা বলে মনে হয় নাম শুনলে, আর আখেরি চাহার শোম্বা কি জানো না? তোকে কোন হারামজাদা চাকরি দিয়েছে? আচ্ছা, মানুষ এমন খারাপ হয় কেন? সেদিন আমি নীরবে কেঁদেছিলাম।
যাহোক, নানা অপমান আর বকাঝকা সহ্য করে টিকে গেলাম প্রফেশনে। প্রথম কর্মস্থলে পেলাম জহির ভাইয়ের স্নেহ ও প্রশ্রয়। বাইরে থেকে তাকে কড়া মনে হলেও ভিতরে ভিতরে রসিক ছিলেন। কোমল মন ছিল্ তার। নরসিংদির রায়পুরায় ছিল তার গ্রামের বাড়ি।
একদিন অফিসে বেড়াতে এলেন তার তরুণি শ্যালিকা। আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার শ্যালিকা। এখন সে সেবিকার ট্রেনিং নিচ্ছে। তারপর বললেন, কী-মুগ্ধ হয়ে দেখছো তো? আরে আমিই যদি আগে শ্যালিকাকে দেখতাম, তাহলে কি আর তোমার ভাবীকে বিয়ে করি।
এমন রসিকতা সবাই করতে পারবে না। কিন্তু জহির ভাই পারতেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে জহির ভাই পত্রিকা বদল করে যোগ দিলেন দৈনিক ইত্তেফাকে। সেখানেও চীফ রিপোর্টার। আর আমিও যোগ দিলাম পূর্বদেশে। জুনিয়র স্টাফ রিপোর্টার। ততদিনে আমারও পেশায় অল্প স্বল্প নাম হচ্ছে। বিশেষ রিপোর্ট জোগাড় করার কৌশল শিখে গেছি।পূর্বদেশ থেকে আমি তৎকালীন স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের সাথে ‘এটাচড’ হলাম। যখন তখন হেলিকপ্টারে স্পিকারের সফরসঙ্গী হচ্ছি। কাগজে রিপোর্ট করছি। আর দৈনিক ইত্তেফাক থেকে ‘এটাচড’ হলেন জহিরুল আলম ভাই। গুরু শিষ্যের সম্পর্ক দাঁড়ালো বন্ধুর মতো। গুরুকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য টেকনাফ সফরে যেয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে লিড স্টোরি করে ফেললাম। গুরুকে নাকি এজন্য ইত্তেফাকের কাছে কথা শুনতে হয়েছিল। খুব মোলায়েম সূরে আমাকে বলেছিলেন, গোপনে কেন টেক্কা দিলা ! জহির ভাই গুরুকে হারালেও গুরু গুরুই। শিষ্যের কাছে গুরুর কখনো হার হয় না। জহির ভাইর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা।