ষোড়শ শতকের শেষভাগে স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, পৃথিবীতে শয়তান সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে। সেখানকার স্থানীয় লোকজন বলাবলি করত, শয়তান শক্তিশালী ঝড় সৃষ্টি, পশুপাখি হত্যা ও প্রাণঘাতী রোগ ছড়াতে পারে। তাদের ধারণা ছিল- শয়তান মানবজাতিকে ধ্বংস করার শপথ গ্রহণ করেছে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্কটিশ সাম্রাজ্যের কর্তাব্যক্তিরা স্থানীয় জাদুকরী বা ডাইনিদের শয়তানের গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করেছিলেন। তখন তারা মানবজাতি ও সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য এই নারী জাদুকরদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নেন, যার মাধ্যমে রচিত হয় এক নারকীয় ইতিহাস, যা পরিচিতি লাভ করেছে ‘উইচ হান্ট’ বা ‘ডাইনি শিকার’ নামে।
তবে জাদুবিদ্যাকে ঘিরে এই আতঙ্ক শুধুমাত্র স্কটল্যান্ডে ছিল বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। ষোড়শ শতকের শেষভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পুরো ইউরোপে এই ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে ডাইনি হত্যার বীজ রোপিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। যা পরবর্তীতে মহামারী রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হতো যে মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাদুকররা শয়তানের উপাসনা শুরু করেছে। ফলে ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলসহ প্রায় সমগ্র ইউরোপে ‘ডাইনি আতঙ্ক’ চরম আকার ধারণ করে।
ষোড়শ শতকে ধর্মীয় পুনর্গঠনের পর ইউরোপে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বিভক্তি ডাইনি দমনে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং উভয় পক্ষই ডাইনি হত্যায় মদদ দিয়েছে। ইউরোপে ধর্মীয় পুনর্গঠনের সময় ইউরোপের শাসকরা নিজেদের ধার্মিকতা জাহির করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। ফলে তারাও অশান্তি, গোলযোগ, অপবিত্রটা ও শয়তানের দোসর হিসেবে জাদুকরদের শক্ত হাতে দমনের আদেশ দিয়েছিলেন।
ইউরোপে ‘উইচ হান্ট’কে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের ধর্মীয় পুনর্গঠনের প্রসার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সেই সময় যাজকপল্লীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং শাসকগোষ্ঠী ‘ধর্মভীরু রাষ্ট্র’ গঠনের দিকে গুরুত্বারোপ করেন। যেখানে পাপ ও অধর্মের কোনো ঠাই হবে না। সকলেই সঠিকভাবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করবে। এমন রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য ইউরোপের অনেক দেশে জাদুকরীদের চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে স্কটল্যান্ড ছিল সবার উপরে।
১৫৯০-১৬৬২ সালের মধ্যে স্কটল্যান্ডে মোট পাঁচবার ডাইনি দমনের ঘটনা ঘটে। ১৫৯০-৯১, ১৫৯৭, ১৬২৮-৩১, ১৬৪৯-৫০ এবং ১৬৬১-৬২ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে ২,৫০০ জন জাদুকর প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী। এদের প্রায় সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। জাদুকরদের দমন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস, যিনি রানী প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ১৬০৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা হন। তখন তার নাম পরিবর্তন করে রাজা প্রথম জেমস রাখা হয়।
রাজা ষষ্ঠ জেমস জাদুকরীদের প্রতি কেন বৈরীভাবাপন্ন ছিলেন?
১৫৬৩ সালে রাজা ষষ্ঠ জেমসের জন্মের কয়েকদিন আগে স্কটিস পার্লামেন্টে জাদুবিদ্যার চর্চাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে আইন পাশ করা হয়। সে সময় জাদুকর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা ছিল গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এই আইন পাশের প্রায় তিন দশক পর জাদুবিদ্যাকে ত্রাস হিসেবে বিবেচনা করে ১৫৯০ সালে স্কটল্যান্ডে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে। আর এই আতঙ্কের সূত্রপাত হয় স্বয়ং রাজা ষষ্ঠ জেমসের মাধ্যমে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে উত্তর সাগরে নৌবিহারে থাকার সময় তাকে এবং তার স্ত্রী অ্যানকে হত্যা করার জন্য ডাইনিরা সাগরে এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের সৃষ্টি করেছিল।
১৫৯১ সালে এগনেস স্যাম্পসন নামে এক জাদুকরের স্বীকারোক্তি শোনার পর রাজা ষষ্ঠ জেমস ‘উইচ ট্রায়াল’ এর অনুমোদন দেন। স্যাম্পসনের দেওয়া তথ্যমতে, ডেনমার্কের কয়েকজনসহ প্রায় ২০০ জাদুকর ১৫৯০ সালের হ্যালোইনের রাতে উত্তর বারউইকের এক চার্চে মিলিত হন। সেখানে স্বয়ং শয়তান তাদের সামনে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং রাজাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। রাজার কর্মচারীদের যেসব জাদুকর এসব তথ্য দিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই নির্যাতনের মুখে প্রাণ হারান। কিন্তু এসব কথা শোনার পর রাজা ষষ্ঠ জেমস স্বভাবতই তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
স্কটল্যান্ডের প্রথম ‘ডাইনি আতঙ্ক’তে প্রাণ হারানোদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ডানকান ও স্যাম্পসন। কিন্তু তারা ছাড়াও আরো অসংখ্য জাদুকর বারউইক ট্রায়ালে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাদের সঠিক সংখ্যা তখন জানা যায়নি। কিন্তু প্রায় ১০০ জনের বেশি জাদুকরকে ট্রায়ালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল।
১৫৯৭ সালে স্কটল্যান্ডে আবারো ডাইনি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এবারও রাজা জেমসকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করার অপরাধে নারী জাদুকরদের দমন করা শুরু হয়। সেই সময় বেলওয়ারির এক কথিত বিশেষ ক্ষমতাধর এক নারী রাজাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তার নাম ছিল মার্গারেট এইটকেন। তিনি তার কথার মাধ্যমে ডাইনি চিহ্নিত করতে পারতেন বলে প্রচার করেন। তার মাধ্যমে প্রায় শত শত নারী জাদুকরকে আটক করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু একসময় এইটকেন একজন ভণ্ড হিসেবে প্রমাণিত হন। তখন যারা ডাইনিদের শাস্তি দিয়েছিলেন তারাও লজ্জায় পড়ে যান।
ঠিক সেই সময় রাজা ষষ্ঠ জেমস নিজের লেখা ‘ডিমেনোলজি (Daemonologie)’ প্রকাশ করেন। তিনি তার এই বইয়ের মাধ্যমে শয়তান ও ডাইনিদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। ডিমেনোলজি বইতে জেমস ব্যাখ্যা করেন কীভাবে শয়তানরা এই বিশ্ব পরিচালনা করছে। তার মতে, শয়তান হলো ফেরেশতা বা অ্যাঞ্জেলসদের মধ্যে থেকে দলত্যাগী। যারা মানুষদের সাথে চুক্তি করে তাদের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেন। আর এই ক্ষমতা হলো গোপন জাদুবিদ্যা। যার মাধ্যমে তারা মানুষের সম্ভাব্য সকল অনিষ্ট করতে সক্ষম। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্রকারী ডাইনিদের মধ্যে যারা আবার ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আনতে চান তাদের ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। তবে ঈশ্বর পৃথিবীতে জেমসের মতো রাজাদের এই ক্ষমা প্রার্থনা বিবেচনা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। তাই তারা চাইলে রাজা ষষ্ঠ জেমসের কাছেও ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন।
পরবর্তী কয়েক বছরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে জেমসের মাথা থেকে ডাইনি শিকারের চিন্তাভাবনা সরে যায়। বিশেষ করে ১৬০৩ সালে রানী প্রথম এলিজাবেথের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর। তিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসার পর সেখানে নতুন এক ধর্মীয় প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হন। ক্যাথলিকরা তাকে সিংহাসন থেকে নামানোর জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। পাশাপাশি তাকে হুমকি দেওয়া অব্যাহত রাখে। ঠিক যেমন বারউইকের ডাইনিরা তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর হুমকি দিয়েছিলেন। ১৬০৫ সালে গান পাউডার প্লটের মাধ্যমে পার্লামেন্টকে উড়িয়ে দিয়ে রাজা জেমসকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন গাই ফকস। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কিন্তু এরপর রাজা জেমস ডাইনিদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে ক্যাথলিক ষড়যন্ত্রকারীদের দমনে মনোনিবেশ করেন।
রাজপ্রাসাদ থেকে সাধারণ মানুষের দ্বারে আতঙ্ক
রাজা জেমসের মনোযোগ ডাইনিদের থেকে সরে গেলেও তাদের ঘিরে যে আতঙ্ক সৃষ্ট হয়েছিল তা স্কটল্যান্ডের প্রতিটি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেঁথে গিয়েছিল। সপ্তদশ শতকে তা রাজপ্রাসাদ থেকে সেখানকার স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ডাইনি শিকার করার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই নিধন স্কটল্যান্ডে একটি ভৌগোলিক নকশা মেনে হয়েছিল। অর্থাৎ যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বসবাস ছিল সেখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক জাদুকরী প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষ করে ফাইফ ও লোথিয়ানে। তবে স্কটল্যান্ডে রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন ধর্মীয় সম্প্রীতি আনয়নে চেষ্টা করা হয়েছিল তখন শয়তানের প্রতি ভীতি সর্বোচ্চ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্কটল্যান্ডের মোট ডাইনি হত্যার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে খুবই অল্প সময়ে। ধারাবাহিকভাবে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের ভূস্বামী ও চার্চের যাজকেরা। প্রথমে চার্চে একটি বৈঠক ডাকা হতো। সেখানে বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা হতো এবং তাদের ধর্মের পথে আনা হতো। পাশাপাশি এসব সভায় যাদের সন্দেহ করা হতো তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি মামলা দায়ের করা হতো।
চার্চের এসব সভায় যে সকল ডাইনিকে সন্দেহ করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশ ছিলেন অবিবাহিত। এ কারণে বিশেষ এই নিয়ামককে চার্চের যাজকেরা সন্দেহের চোখে দেখতেন। এবং তারা ধারণা করতেন এসব অবিবাহিত নারীরা শয়তানের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত। তবে স্কটল্যান্ড থেকেই ডাইনিদের ঘিরে অধিকাংশ গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও কিছু ঘটনার পেছনে বিদেশীদেরও ভূমিকা ছিল। বেশ কিছু ঘটনার সূত্রপাত জার্মানি থেকে হয়েছিল।
যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল
যেসব জাদুকরকে শয়তানের গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিলেন বৃদ্ধ ও ঝগড়াটে নারী। এমনকি কখনো কখনো একক কোনো প্রতিবেশীর অভিযোগের ভিত্তিতেও অনেককে আটক করা হতো। প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজন কোনো জাদুকর যদি কোনোভাবে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করতেন এবং আরো কোনো সহযোগীর নাম বলতেন তাহলে তার নামের সাথে আরো অনেক অভিযোগ জুড়ে দেওয়া হতো।
তবে ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করার অতি সাধারণ এক মাপকাঠি ছিল ঝগড়া করার স্বভাব। মাঝে মাঝে প্রতিবেশী কোনো শত্রুকে ফাঁসানোর জন্যও অনেকে উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করতেন। আর এতে কাজও হতো। সেই হিসেবে স্কটল্যান্ডে ডাইনি হত্যার মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক কলহ ও অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতার হারানোর ভয়। অভিজাত শ্রেণীর লোকজন শয়তানকে তাদের বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। যদিও শয়তানের কোনো প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছিল না। এরপরও তাদের দোসর হিসেবে অনেক নিরপরাধ জাদুকরদের প্রাণ হারাতে হয়েছে, যাদের শতকরা ৮৫ ভাগই ছিলেন নারী। এদের আবার অনেকে জাদুবিদ্যা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না।
তবে প্রাথমিকভাবে যাদের সন্দেহ করা হতো তাদের বেশ কিছু বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে দোষী সাব্যস্ত করা হতো। এর মধ্যে শরীরে শয়তানের চিহ্ন সনাক্তকরণ ছিল অন্যতম। প্রথমে স্থানীয় আদালত অভিযুক্তদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতো। এসব যাচাই বাছাই থেকে বেশ কিছু প্রমাণাদি সংগ্রহ করার পর তাদের এডিনবার্গে আরো বিস্তর পরীক্ষা করার পাঠানো হতো। সেখানে শরীরে থাকা রহস্যজনক কোনো দাগ বা চিহ্নের খোঁজ করা হতো। কিন্তু অনেকের শরীরে বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত দাগ কিংবা কোনো চর্মরোগ থাকতো। সেসবের ভিত্তিতেও তাদের অভিযুক্ত করা হতো।
নির্যাতনের মাধ্যমের স্বীকারোক্তি আদায়
স্কটল্যান্ডের ডাইনি শিকারীরা নির্যাতনের মাধ্যমে সন্দেহভাজনদের কাছে থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতেন। তবে সেটা যে পুরোপুরি ইচ্ছাকৃতভাবে তেমন নয়। বরং তখন এটা একটা রীতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। বর্তমান সময়ের রিমান্ডের মতো তখন সন্দেহভাজনদের কাছে সহযোগীদের নাম জানতে চাওয়া হতো। কিন্তু উত্তর যদি সন্তোষজনক না হতো তাদের নির্যাতন করা হতো।
নির্যাতনের সাধারণ এক পদ্ধতি ছিল ঘুমাতে না দেওয়া। টানা তিন দিন না ঘুমাতে দেওয়ার ফলে সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা প্রশ্ন মোকাবেলা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতেন। পরবর্তীতে তারা হ্যালুসিনেশনে ভুগতে শুরু করতেন। এবং একপর্যায়ে জিজ্ঞাসবাদে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেন। যার কিছু কিছু একেবারেই অবিশ্বাস্য হতো। কিন্তু বিচারিক আদালত সেসব নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলতো না। এমনকি আদালত কখনো কোনো জাদুকরের শক্তিমত্তারও প্রমাণ দেখতো না। তারা শুধুমাত্র জবানবন্দির ভিত্তি করে নারী জাদুকরদের অভিযুক্ত করতেন। যে স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো পুরোপুরি নির্যাতনের মাধ্যমে। পরবর্তীতে অনেক ডাইনিকে পুড়িয়ে ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়।
অবশেষে আতঙ্কের অবসান
সপ্তদশ শতকের শেষভাগে ধর্মীয় বহুত্ববাদ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে। একইসাথে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় শয়তানের গুপ্তচর বিষয়টি হাস্যকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এছাড়া আদালতও এসব ক্ষেত্রে জোর করে নেওয়া জবানবন্দি গ্রহণে আপত্তি জানায়। ফলে ধীরে ধীরে স্কটল্যান্ডে ডাইনি নিধনের নিষ্ঠুরতা কমে আসে। ১৬৬২ সালের পর তা রাষ্ট্রের জন্য আর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। যদিও গ্রামের দিকে এই আতঙ্ক আরো কয়েক দশক টিকে ছিল। কিন্তু সেটা আর বড় কোনো মহামারী আকার ধারণ করতে পারেনি।
স্কটল্যান্ডে সর্বশেষ ডাইনি শিকারের ঘটনা ঘটে অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে। পিটেনউইমে চারজন নারীকে শয়তানের গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু আদালত তাদের বিচার না করে মুক্তি দেওয়ার আদেশ প্রদান করে। চারজনের মধ্যে একজন গণপিটুনিতে প্রাণ হারান। সবশেষে ১৭২৭ সালে ডরনোচে একজনকে জাদুবিদ্যা চর্চার জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়। এরপর ১৭৩৬ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৫৬৩ সালের বিতর্কিত আইন বাতিল করে দেয়। সেই সাথে বিভিন্ন স্থানে আইনের কারণে প্রাণ হারানো অনেকের প্রতিকৃতি তৈরি করে সম্মান জানানো হয়।
স্কটল্যান্ডে নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে বড় কারণ ছিল লোক সংস্কৃতির সাথে অভিজাতদের সংযোগের অভাব। এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ও প্রকৃত তথ্য যাচাই-বাছাই না করার প্রবণতা। যার ফলশ্রুতিতে প্রাণ দেন ২,৫০০ জনের বেশি নারী। যাদের কেউ কেউ জাদুবিদ্যা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু কুসংস্কার ও ভ্রাতৃ বিশ্বাসের কারণে তাদের নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছিল।