নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: বাংলার পথে-প্রান্তরে, মাঠেঘাটে এখন এক নতুন দৃশ্যপট। হেমন্তের শেষে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে নিয়েছে প্রকৃতি। বিশেষ করে উত্তরের জনপদ কুড়িগ্রামে, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ আর গ্রামীণ জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তন এখন স্পষ্ট।
খেজুরের রস: শিউলিদের ব্যস্ততা
শীত মানেই বাংলার ঘরে ঘরে খেজুরের রসের মিষ্টি গন্ধ। কুড়িগ্রামের গ্রামগুলোতে এখন তাকালেই চোখে পড়ে খেজুর গাছে ঝুলছে ছোট্ট রসের হাঁড়ি। কোথাও আবার গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন দক্ষ শিউলিরা (যারা গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন)। ভোরের হিমেল হাওয়ায় গাছ কেটে নলি বসানো এবং ফোঁটা ফোঁটা রস সংগ্রহ করার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। এই রস থেকে তৈরি হবে সুস্বাদু গুড় ও পাটালির মতো শীতকালীন মিষ্টি সামগ্রী, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
মাঠজুড়ে সোনালি আভা: কুয়াশা ও ফসলের সমারোহ
ফসলের মাঠজুড়ে এখন সোনালি আভায় সকাল-সন্ধ্যা জমতে থাকে হিম হিম কুয়াশা। মাঠে মাঠে চলছে রবি শস্যের পরিচর্যা। শীতকালীন সবজি এবং নতুন ধানের ফলনের প্রস্তুতি বা কর্তনের কাজ চলছে। কৃষকদের চোখে-মুখে নতুন ফসলের স্বপ্ন। ভোরের নরম আলোয় কুয়াশার বুক চিরে কৃষকদের মাঠে কাজ করতে যাওয়ার দৃশ্য বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে তুলে ধরে।
হাট-বাজারের ডালায় শীতের সবজি
শীতের আগমনে স্থানীয় হাট-বাজারগুলো ভরে উঠেছে টাটকা সবজিতে। বাজারের সবজির সারির ডালায় ডালায় থরে থরে সাজানো শীতের সবজি—ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, শালগম, ওলকপি, গাজর, টমেটো। কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমে উৎপাদিত এই সবজিগুলি কেবল স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং জেলার বাইরেও সরবরাহ হচ্ছে, যা কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস। সবজির এই বিপুল সমারোহ বাজারে শীতকালীন অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য ফুটিয়ে তুলেছে।
নদীর বুকে চর জাগা দৃশ্য: প্রকৃতির রুক্ষতা
এদিকে, শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় কুড়িগ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর চিত্রও পাল্টে গেছে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ও দুধকুমারের মতো প্রধান নদীগুলোর বুকে কোথাও এখন হাঁটুজল, কোথাও বা খটখটে চর জাগে। এই চরগুলোতে অনেকে অস্থায়ীভাবে শীতকালীন ফসল চাষাবাদ শুরু করেছেন, যা এই অঞ্চলের মানুষের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার অদম্য লড়াইকে তুলে ধরে। তবে, নদীর জল কমে যাওয়ায় এক দিকে যেমন মাছ ধরার কাজে বিরতি আসে, তেমনি শুষ্কতার কারণে সেচের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে।
কুড়িগ্রামের পথে পথে শীতের এই বার্তা একদিকে যেমন প্রকৃতির রূপের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তেমনি স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে নিয়ে এসেছে নতুন ব্যস্ততা। খেজুরের রস, টাটকা সবজি আর ফসলের সোনালী মাঠ—সব মিলিয়ে এই উত্তরাঞ্চলে এখন নবান্ন ও শীতের অর্থনীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।










