Home অন্যান্য দাসপ্রথার নৃশংস অতীত

দাসপ্রথার নৃশংস অতীত

আমিরুল মোমেনিন:

ইতিহাসে দাসপ্রথা ছিল এক বর্বরতম ব্যবস্থা, যেখানে মানুষকে পণ্য হিসেবে কেনা-বেচা করা হতো, তাদের মানবিক অধিকার অস্বীকার করা হতো এবং পশুর মতো শ্রম দিতে বাধ্য করা হতো। তবে প্রশ্ন হলো—আজ, যখন আমরা বিলোপ দিবসের কথা বলছি, তখন কি সত্যিই মানুষের শৃঙ্খল সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে?

ঔপনিবেশিক শাসনকালে আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশে দাসপ্রথার যে ভয়াবহ রূপ দেখা গিয়েছিল, তা মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। লাখ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক তাদের মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে আনা হয়েছিল এবং বাগানে, খনিতে বা গৃহস্থালির কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: দাসদের ওপর নিয়মিতভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো। চাবুকের আঘাত ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। তাদের নিজেদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো, এবং জীবনধারণের ন্যূনতম অধিকারও তাদের ছিল না।

পণ্যের মতো ব্যবহার: তাদের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যাদের কোনো আইনি অধিকার ছিল না। দাস-মালিকের ইচ্ছাই ছিল তাদের একমাত্র আইন। বহু ঐতিহাসিক নথিতে দাসদের নিলামে বিক্রির হৃদয়বিদারক বর্ণনা রয়েছে, যা প্রমাণ করে মানুষের প্রতি চরম অবমাননা।

আধুনিক দাসত্বের নির্মম বাস্তবতা

জাতিসংঘের মতে, যদিও দাসপ্রথার চিরাচরিত রূপ বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে তা বিভিন্ন নতুন রূপে সমাজে বিদ্যমান। এই আধুনিক দাসত্ব এক নীরব এবং বিস্তৃত সমস্যা।

জোরপূর্বক শ্রম: লাখ লাখ পুরুষ, নারী ও শিশু জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ঋণের দায়ে গোলামি, যেখানে একজন মানুষ বংশপরম্পরায় ঋণ পরিশোধের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়। নির্মাণ শিল্প, পোশাক শিল্প, কৃষি এবং খনি শিল্পে এই শ্রমের শোষণ বেশি দেখা যায়।

মানব পাচার: এটি আধুনিক দাসত্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ। নারী ও শিশুদের যৌন শোষণ, জোরপূর্বক বিবাহ বা অন্যান্য শ্রমের জন্য পাচার করা হয়। পাচারকারীরা তাদের শিকারদের স্বাধীনতা ও পরিচয় কেড়ে নেয়।

শিশুশ্রম: ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার করা আধুনিক দাসত্বেরই নামান্তর। শিক্ষা ও স্বাভাবিক শৈশব থেকে বঞ্চিত হয়ে এই শিশুরা তাদের জীবনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা হারায়।

জোরপূর্বক বিবাহ ও যৌতুক প্রথা: বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, জোরপূর্বক বিবাহ অনেক ক্ষেত্রে নারীকে এক ধরণের গার্হস্থ্য দাসত্বে ঠেলে দেয়, যেখানে তাদের কোনো স্বাধীনতা থাকে না।

নীরবতার প্রাচীর ভাঙতে হবে

‘বৈশ্বিক দাসত্ব সূচক’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এখনও কয়েক কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার। এই সমস্যাটি কেবল দরিদ্র দেশগুলিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং উন্নত দেশগুলির পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল এবং গোপন আস্তানাতেও এর শেকড় গেঁথে আছে।

২ ডিসেম্বর দাসপ্রথা বিলোপ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমাদের এই বর্বর প্রথার অতীত নৃশংসতাকে স্মরণ করতে হবে এবং একই সঙ্গে বর্তমানের নীরব শৃঙ্খল ভাঙার অঙ্গীকার করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইনি প্রয়োগ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা ছাড়া এই মানবতাবিরোধী অপরাধের সম্পূর্ণ বিলোপ সম্ভব নয়। দাসত্ব যেকোনো রূপেই হোক না কেন, তা মানবতার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। আজকের দিনে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান, যাতে তারা এই নীরব নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও বেশি আন্তরিক ও উদ্যোগী হয়।