Home অন্যান্য অমলিন স্মৃতি, অবিস্মরণীয় অগ্রজ : আবদুর রশিদ চৌধুরীর কথা

অমলিন স্মৃতি, অবিস্মরণীয় অগ্রজ : আবদুর রশিদ চৌধুরীর কথা

আবদুর রশিদ চৌধুরী

কামরুল ইসলাম:

অগ্রজ সাংবাদিক আবদুর রশিদ চৌধুরী, কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বয়সের ব্যবধান প্রচুর  হলেও, প্রথম সাক্ষাতেই যেন এক অদ্ভুত সান্নিধ্যে বেঁধেছিলেন আমাকে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে সংবাদ-এর সুবাদে। আমি তখন সংবাদ-এর বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার, আর তিনি  কুষ্টিয়া প্রতিনিধি। প্রায় চার দশক আগে, সংবাদ কার্যালয়ে তার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটি আজও চোখে ভাসে। বয়স তখন তার ৪২ থেকে ৪৪-এর মধ্যে, আমি তার অর্ধেকের বেশি হলেও স্নেহ আর আন্তরিকতায় তিনি বয়সের ফারাক ভুলিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথম সাক্ষাতেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বুঝতে পারলাম, তিনি সংবাদ-এ জড়িত আমার অনেক আগে থেকে, সহকর্মিরাও তাকে যথেষ্ট সমীহ করতেন। পরবর্তীকালে আমি যখন সংবাদ-এ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিই, তখন যোগাযোগ আরও ঘন হয়ে ওঠে। অনেক সময় টেলিফোনে সংবাদ পাঠাতেন, আর সেই সংবাদ লিখে নেওয়ার দায়িত্ব থাকত আমার। সে সময়ে ই-মেইল ছিল না। সংবাদপত্রের ব্যস্ত দুনিয়ায় এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল এক আত্মীয়তাসুলভ সম্পর্ক।

আবদুর রশিদ চৌধুরী শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ। চারুকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন ঢাকা আর্ট কলেজে, পরে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা লাভ করেছিলেন ভারতে। তার চলাফেরার ধরণও ছিল ভিন্নতর। সব সময় কাঁধে ঝোলানো থাকত একটি ক্যামেরা, আর চলাচলের মাধ্যম ছিল মোটরসাইকেল। চোখে মুখে ছিল অনুসন্ধিৎসু দীপ্তি—যেন প্রতিটি মুহূর্তই তিনি ধারণ করতে চান সংবাদে, সাহিত্যে কিংবা ছবিতে।

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কয়েকবার কুষ্টিয়া যাওয়া হয়েছিল আমার। প্রতিবারই গিয়েছি তার কাছে। ঝিনেদা সড়কের পাশে, ডিসি কোর্টের বিপরীতে ছিল তার সাপ্তাহিক জাগরণী পত্রিকার অফিস। অদূরে তার বাসভবন। সেখানেই তিনি আমাকে আপনজনের মতো গ্রহণ করেছেন। অনেকগুলো ছবি তুলেছিলেন আমার—কখনো অফিসে, কখনো তার বাড়িতে, কখনোবা বেড়াতে নিয়ে যাওয়া পথে। মনে আছে, একবার নিয়ে গিয়েছিলেন তার শ্বশুরবাড়ি পাবনার কাচারি পাড়ায়। আরেকদিন কুষ্টিয়ার বনানী হলে সিনেমা দেখিয়েছিলেন—ছবির নাম দি ফাদার। এ যেন সাংবাদিকতার সূত্রে পাওয়া এক স্নেহময় বন্ধন, যা পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে গিয়ে ব্যক্তিজীবনের উষ্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছিল।

তার স্ত্রী তাছলিমা চৌধুরী বুলবুলও সাহিত্যস্রষ্টা—একজন ছড়াকার। নন্দন নামে তিনি একটি ছড়াপত্র প্রকাশ করতেন। দাম্পত্য জীবনে তারা ছিলেন দুজনেই সৃষ্টিশীল মানুষ, যার প্রভাব পড়েছিল কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।

জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন সংবাদপত্র, সাহিত্য আর সংস্কৃতির আলোছায়ায়। সাংবাদিকতা করেছেন নিবেদিত প্রাণ হয়ে। কুষ্টিয়া লালন একাডেমি থেকে প্রেসক্লাব—প্রায় সব জায়গাতেই তার পদচারণা। কুষ্টিয়ার মানুষ তাকে চেনেন একজন অবিচল সাংবাদিক, একজন নিবেদিত সংগঠক এবং একজন সৃজনশীল আত্মা হিসেবে।

আজ বয়সের ভার আর বার্ধক্যজনিত নানা ব্যাধি তাকে নানাভাবে আক্রান্ত করেছে। কিছুদিন আগেও অবস্থার অবনতি হয়েছিল গত আগস্টে, এখন আপাতত ভালো আছেন। আমরা যারা তার সান্নিধ্যে থেকেছি, তাদের কাছে তিনি শুধু একজন সাংবাদিক নন, বরং অভিজ্ঞতার সঞ্চয়পাত্র, স্নেহময় অগ্রজ এবং এক অবিস্মরণীয় চরিত্র।

আমি স্মরণ করি সেই দিনগুলিকে, যখন সংবাদ-এ বসে তার পাঠানো খবর লিখেছি, ফোনে তার কণ্ঠ শুনেছি, কিংবা কুষ্টিয়ার অলিগলিতে তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে ঘুরেছি। সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমার সাংবাদিক জীবনের অমূল্য সম্পদ।

আবদুর রশিদ চৌধুরী শুধু কুষ্টিয়ার নয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক মহৎ নাম হয়ে থাকবেন। তার সৃষ্টিশীলতা, আন্তরিকতা আর মানবিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবে।

১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর তৎকালীন নদীয়া জেলার কু্ষ্টিয়া মহকুমায় জন্ম রশিদ চৌধুরীর। 

আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। তার জীবন যেন থেকে যায় আমাদের স্মৃতির আয়নায়—অগ্রজ, সহকর্মী ও প্রিয় মানুষ আবদুর রশিদ চৌধুরী হিসেবে।