বাজারে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’
নয়ন দাস, উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি:
দেশে গত মৌসুমে আলুর রেকর্ড ফলন হলেও তা আশীর্বাদের বদলে কৃষকের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি হিসাবে ১ কোটি ১৫ লক্ষ টন আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৫ লক্ষ টন বেশি। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত উৎপাদনই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলের আলুচাষি ও হিমাগার মালিকদের জন্য। কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া ও উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারমূল্য অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, গত ৩০ নভেম্বর হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সময়সীমা শেষ হলেও রাজশাহীর ৪৬টি হিমাগারে এখনও প্রায় ৬ লাখ বস্তা আলু মজুদ রয়েছে। হিমাগারের ভাড়াই যেখানে প্রতি কেজি ৬ টাকা ৭৫ পয়সা, সেখানে বর্তমানে শুকনা আলুর বাজারদর মাত্র ৫-৬ টাকা কেজি। অর্থাৎ, আলু বিক্রি করে হিমাগার ভাড়াই পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
তানোরের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানের ভাষায়, “এক বস্তা আলুর ভাড়া ৪৫০ টাকা, কিন্তু বাজারে সেই বস্তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০০ টাকায়।” এই অস্বাভাবিক লোকসানের ভয়ে অনেক কৃষক হিমাগারের দিকেই পা বাড়াচ্ছেন না। ফলে হিমাগার মালিকরা ভাড়া ও ঋণ বাবদ প্রায় ৫০ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
পুরানো আলুর এই জট কাটিয়ে ওঠার আগেই বাজারে এসেছে নতুন আগাম জাতের আলু। কিন্তু সেখানেও কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সার, সেচ ও মজুরি বৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ কেজিতে ২২-২৫ টাকা। আর বিক্রয় মূল্য কেজি প্রতি মাত্র ১০-১২ টাকা (রংপুরে যা ৭-১০ টাকা)।
বগুড়ার কৃষক আব্দুল মালেকের মতো হাজারো চাষি এখন প্রতি কেজিতে ১০-১৫ টাকা লোকসান দিচ্ছেন। এমনকি আলুর দাম এতটাই কমেছে যে, অনেক স্থানে চাষিরা আলু তুলে তা গবাদি পশুকে খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৃষকদের অভিযোগ, সরকার আলু ব্যবস্থাপনা ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে যেসব উদ্যোগের কথা বলেছিল, তার কোনো প্রয়োগ নেই। গত আগস্টে হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের ৫০ হাজার টন আলু সংগ্রহের পরিকল্পনাও আলোর মুখ দেখেনি।
রপ্তানির ক্ষেত্রে মানসম্মত কোল্ড-চেইন লজিস্টিকসের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারেও কাঙ্ক্ষিত আলু পাঠানো যাচ্ছে না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক এই পরিস্থিতিকে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, “এভাবে লোকসান হতে থাকলে আগামী মৌসুমে কৃষকরা আলু চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এর ফলে ভবিষ্যতে আলুর তীব্র সংকট এবং দামের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, যা সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা ডেকে আনবে।”










