বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ: তিন রুমের ছোট একটি বাসা। সাধারণ চোখে হয়তো নিছক বসবাসের স্থান। কিন্তু সিরাজগঞ্জ শহরের কলেজ রোড এলাকায় সেই ঘরই যেন ইতিহাসের জীবন্ত সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ী মুনিরুজ্জামান আল ফারুক নূরে এলাহীর শখ আর মমতায় তৈরি হয়েছে এক ব্যতিক্রমী ‘জাদুঘর’, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে বাদশাহী আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান-পূর্ববর্তী সময়ের অসংখ্য দুর্লভ স্মারক।
তাঁর সংগ্রহশালায় পাওয়া গেছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ধরনের প্রাচীন বস্তু, যার প্রতিটি যেন একেকটি ইতিহাসের কড়চা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের থ্রি-ব্র্যান্ড রেডিওতে এখনও স্পষ্ট ভেসে আসে আব্দুল আলীমের গান। এমন রেডিওতেই এক সময় শোনা হতো স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ। আশির দশকের গ্রামোফোন, নব্বইয়ের ক্যাসেট প্লেয়ার—সবই এখানে জীবন্ত। সুইচ টিপলেই সুরে ভরে ওঠে ঘর।
শোকেসে তাকিয়ে দেখা যায় উটের হাড়ের তসবিহ, জমিদার আমলের হুক্কা, কবিরাজি ওষুধ রাখার পাত্র, তামা-পিতলের কুপি বাতি, পুরনো দেওয়াল ঘড়ি, টাইপ মেশিন, ভয়েস রেকর্ডার, ক্যামেরা, এমনকি সাংবাদিকদের ব্যবহৃত ১৯৭১-পরবর্তী সময়ের যন্ত্রপাতিও। বিস্ময় জাগায় আকারে মাত্র অর্ধ ইঞ্চির একটি কোরআন শরীফ, যেটির পাশে আছে দেড় ইঞ্চি ও সোয়া ইঞ্চির আরও কয়েকটি কপি। তাকগুলোতে সাজানো রয়েছে শতাধিক দেশের পুরোনো মুদ্রা ও ডাকটিকিট, অসংখ্য হাতের লেখা চিঠি ও ম্যাচ বক্সও।
মুনিরুজ্জামান নিজেই বললেন তাঁর সংগ্রহের গল্প। বললেন, “প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই ডাকটিকিট জমাতাম। প্রতি বছর বিজ্ঞান মেলায় প্রজেক্ট তৈরি করে পুরস্কার পেতাম। একবার জাতীয় জাদুঘর দেখে মনে হলো—এমন কিছু তো নিজের কাছেও রাখা যায়! সেই থেকেই শুরু।”
জানালেন, “যেখানে যা পাই, সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। অনেকে পাগলও বলে। ৪৪ বছর ধরে সংগ্রহ করছি। বাসা না থাকায় এখনো সবার জন্য খোলা রাখতে পারিনি। তবে সরকার সহযোগিতা করলে গণজাদুঘর করে দিতে চাই।”
মুনিরুজ্জামান আল ফারুকের রক্তেই যেন ইতিহাস। তাঁর বাবা ভাষা সৈনিক আবুল ফাত্তাহ নূরে এলাহী, ফুপু ভাষা সৈনিক মেহের নিগার নূরে এলাহী এবং চাচা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবুল কাশেম নূরে এলাহী। ১৯৪০ সালে তাঁর দাদা সিরাজগঞ্জে ‘নূরে এলাহী প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল উত্তরবঙ্গে মুসলমানদের প্রথম মুদ্রণশিল্প প্রতিষ্ঠান।
তৃতীয় প্রজন্মের এই উত্তরসূরি সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন শুধু ব্যবসায় নয়, ইতিহাসকেও আগলে রেখে। এখন তাঁর একটাই স্বপ্ন নিজস্ব জায়গায় একটা উন্মুক্ত জাদুঘর তৈরি করে সাধারণের দেখার সুযোগ করে দেওয়া।