ধারাবাহিক প্রতিবেদন: পবিত্র আহ্বানের পথে পর্ব-৪
মওলানা মোহাম্মদ কাউসার: হজ একটি নির্ধারিত পদ্ধতি ও ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে পালনীয়। এতে রয়েছে সময়, স্থান ও নিয়মকানুনের কঠোর অনুসরণ। প্রতিটি ধাপে জড়িয়ে আছে আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ, ধৈর্য ও আনুগত্যের দীক্ষা। যারা হজে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য এই প্রতিটি ধাপ জানার ও হৃদয়ে ধারণ করার গুরুত্ব অপরিসীম।
ইহরাম: দুনিয়াবি পরিচয়ের অবসান
হজযাত্রা শুরু হয় ইহরাম অবস্থান থেকে। ইহরাম মানে শুধু একটি সাদা কাপড় পরিধান নয়, বরং এটি একজন মুসলমানের অহংকার, পার্থিব ভেদাভেদ এবং আরাম-আয়েশের পছন্দ থেকে বের হয়ে আসা। পুরুষেরা দুটি সাদা আনসেলাইড কাপড় পরে, নারীরা স্বাভাবিক পোষাক পরেন—তবে মুখ ও হাত ঢাকা নিষিদ্ধ।
এই অবস্থায় নামায পড়ে নিয়ত করতে হয় “হজের নিয়তে ইহরাম গ্রহণ করছি, হে আল্লাহ, আমি হাজির!” এরপর উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ শুরু হয়—
“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক…”
তালবিয়া পাঠের সঙ্গে সঙ্গে হাজীর হৃদয় প্রস্তুত হয় একটি অনন্য অভিজ্ঞতার জন্য।
তাওয়াফ: কাবা ঘিরে ভালোবাসার আবর্তন
মক্কায় পৌঁছে হাজীগণ প্রথম যে কাজটি করেন, তা হলো তাওয়াফ। অর্থাৎ কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে সাতবার ঘোরাফেরা করা। এটি হজের আবেগঘন অংশ, যেখানে আল্লাহর ঘরের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে হাজী দোয়া করেন, কাঁদেন, আর হৃদয় খুলে আল্লাহর সামনে নিজেকে সমর্পণ করেন।
প্রথম তিন চক্করে হালকা দ্রুত গতিতে চলা সুন্নত। কাবার দক্ষিণ কোণায় স্থাপিত হজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া বা ইশারা করা একটি সম্মানজনক আমল, তবে তা সম্ভব না হলে ইশারাই যথেষ্ট।
সাঈ: হাজেরা (আ.)-র স্মৃতি
তাওয়াফের পর হাজী যান সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাঈ করতে। এটি সাতবার পাহাড়দ্বয়ের মাঝে চলাফেরা, যা হজরত হাজেরা (আ.)-র শিশু পুত্র ইসমাইলের জন্য পানি খোঁজার দুর্দান্ত চেষ্টার স্মৃতি।
এই সাঈ আমাদের শেখায় পরিশ্রম, আশা ও আল্লাহর ওপর অটুট ভরসাই সফলতার চাবিকাঠি।
মিনায় যাত্রা: এক বিশাল মানবিক সমাবেশের সূচনা
হজের নির্ধারিত তারিখে হাজীগণ মিনায় গমন করেন, যেখানে তাঁরা রাত যাপন করেন। এটি হজের মূল অংশ শুরুর ইঙ্গিত। লক্ষ লক্ষ হাজী একত্রে খোলা মাঠে রাত কাটান। উচ্চ-পদস্থ কিংবা দরিদ্র সবাই একই স্থানে, একই চাদরে, একই নিয়মে রাত্রি যাপন করেন।
এই সমতা ইসলামের অন্যতম মৌলিক বার্তা।
আরাফাতের ময়দান: হজের মূল রোকন
এরপর হাজীরা যাত্রা করেন আরাফাতের ময়দানে, যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা (ওকুফে আরাফা) হজের মূল কাজ। রাসুল (সা.) বলেন “হজ হলো আরাফা।” ৯ জিলহজ দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান, দোয়া ও কান্নাকাটির মধ্যে দিয়ে হাজীগণ আল্লাহর করুণা লাভের চেষ্টা করেন।
এ দিন মানুষের পরকালীন জমায়েতের এক প্রতীকী চিত্র তৈরি হয় সাদা পোশাকে অসংখ্য মানুষ আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে।
মুজদালিফা ও কঙ্কর সংগ্রহ
সূর্যাস্তের পর হাজীরা যান মুজদালিফা, যেখানে রাত যাপন এবং কঙ্কর সংগ্রহের নিয়ম। এই কঙ্কর ব্যবহার হয় পরদিন শয়তানকে প্রতীকী নিক্ষেপ করার জন্য।
এই অংশটি আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য ও নিয়মমাফিক হজ পালনের আরেকটি অনুশীলন।
ইহরাম থেকে শুরু করে আরাফা, মুজদালিফা হজের প্রতিটি ধাপ একটি আত্মিক ও শারীরিক যাত্রার অংশ। এতে রয়েছে আত্মত্যাগ, ঈমান পরীক্ষা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ।
যাঁরা হজে যাচ্ছেন, তাঁদের উচিত এই প্রতিটি ধাপের তাৎপর্য বুঝে পালন করা। তাহলেই হজ হবে শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা।
পরবর্তী পর্ব: মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ এবং কুরবানি: ত্যাগের প্রতীক
👉 আরও খবর ও বিশ্লেষণ পেতে নিয়মিত ভিজিট করুন বিজনেসটুডে২৪.কম।
👉 প্রতিবেদনটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে শেয়ার করুন বন্ধুদের সঙ্গে।