নেতৃত্বহীনতার দীর্ঘ ছায়ায় ব্যবসায়ী সমাজ
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: গণঅভ্যুত্থানোত্তর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এখনো নেতৃত্ব সংকটে। একাধিক প্রশাসকের দায়িত্ব ও মেয়াদ বাড়ানো, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও স্থগিতের পুনরাবৃত্তি সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই সংগঠন কার্যত নেতৃত্বহীন অবস্থায় রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরপরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এফবিসিসিআইয়ের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে দেয়। পরে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর দায়িত্ব ছিল ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে নবনির্বাচিত পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। কিন্তু সেই ১২০ দিনের প্রতিশ্রুতি এখন ১৩ মাসে গড়িয়েছে, নির্বাচন হয়নি এখনো।
হাফিজুর রহমানের মেয়াদ একাধিক দফায় বাড়ানো হলেও সর্বশেষ মেয়াদও শেষ হয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে কোনো নতুন প্রশাসক নিয়োগ না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি এখন কার্যত অভিভাবকহীন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মুহাম্মদ রেহান উদ্দিন বলেন, “এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। আগেরজনও থাকতে পারেন, আবার নতুন কেউও আসতে পারেন।”
বাণিজ্য সংগঠন পরিচালনা বিধিমালা নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী এর বিভিন্ন ধারায় আপত্তি জানানোর পর বিষয়টি আদালতে গড়ায়। সম্প্রতি বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে এ নিয়ে বৈঠকও হয়েছে। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশোধিত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন বিধিমালা অনুমোদনের পরই নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
চলতি বছরের জুনে ২০২৫–২৭ মেয়াদি নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী বোর্ড ও আপিল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। বোর্ড ১৮ জুন তফসিল ঘোষণা করে ভোটের তারিখ নির্ধারণ করে ৭ সেপ্টেম্বর। কিন্তু পরবর্তীতে নানা জটিলতায় ভোট ৪৫ দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই উচ্চ আদালতের আদেশে নির্বাচনী বোর্ড ও আপিল বোর্ড পুনর্গঠন হয়। ফলে প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি থমকে যায়।
যদিও নির্বাচন স্থগিত, তবু প্রার্থীরা প্রচারণায় ব্যস্ত। অন্তত ছয়জন ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং নিজেদের প্যানেল গোছানোর কাজও এগিয়ে নিচ্ছেন। তবু অনেকের মনে প্রশ্ন এই নির্বাচন আদৌ হবে কি না? কারণ, ডিসেম্বরের শেষ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা থাকায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে এফবিসিসিআইয়ের ভোট আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
একাধিক চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করেছেন, “এফবিসিসিআইকে নেতৃত্বশূন্য করে রাখা হচ্ছে। এতে সরকারী দপ্তরে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।” কেউ কেউ সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সংগঠনে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।
একজন সিনিয়র ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “দায়িত্ব গ্রহণের ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। এখন ১৩ মাস পার হয়ে গেছে। এটি কোনো প্রশাসনিক জট নয়—এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।”
ব্যবসায়ী সমাজের প্রত্যাশা, সরকার যেন দ্রুত প্রশাসক নিয়োগ করে নির্দলীয় ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে। কারণ, এফবিসিসিআই শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি দেশের বাণিজ্যনীতির মুখপাত্র, যা সরকারি নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সংগঠনটি নেতৃত্বহীন থাকা শুধু ব্যবসায়ী সমাজের জন্য নয়, পুরো অর্থনীতির জন্যও অস্বস্তিকর এমন মত দিয়েছে অর্থনীতিবিদ ও চেম্বার নেতারা।
এক ব্যবসায়ী নেতার কথায়, “দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী সংগঠন যদি নেতৃত্বহীন থাকে, তাহলে সেটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য শুভ বার্তা নয়। নির্বাচনের এই অনিশ্চয়তা দ্রুত কাটাতে হবে।”
নির্বাচনের ঘোষণা, স্থগিতাদেশ, বোর্ড পুনর্গঠন, আবার নতুন প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তুতি সব মিলিয়ে এফবিসিসিআই নির্বাচন এখন অনিশ্চয়তার ঘন কুয়াশায়। আর সেই কুয়াশার মধ্যেই ব্যবসায়ী সমাজ খুঁজছে নেতৃত্বের আলোর দিশা।










