- হয়রানিমুক্ত ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের উদ্যোগ
- নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা
- ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও এসএমই ঋণ সহজীকরণ
- নারী ও যুব উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি
- সদস্যদের স্বার্থ রক্ষায় প্রকৃত সেতুবন্ধন
- সততা ও অভিজ্ঞতায় এফবিসিসিআইকে রূপান্তরের লক্ষ্য
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রার্থীদের কর্মতৎপরতা ততই বাড়ছে। এবারের সভাপতি প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত নাম ড. মো. পারভেজ সাজ্জাদ আকতার। তিন দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা এবং একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পরিবারের উত্তরাধিকার—এই সবকিছুর মিশেলে তিনি নিজের প্রার্থিতাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় তার দর্শন এবং সাধারণ সদস্যদের জন্য তার ভাবনাগুলো জানতেই আমাদের এই বিশেষ আয়োজন। বিশেষ সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত নিম্নে দেয়া হলো।
প্রশ্ন ১: আপনার ব্যবসায়িক জীবন শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৬ বছর আগে, বাবার হাত ধরে। ব্যবসায়ী সংগঠন এর সাথে ১৯৯২ সাল হতে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালকসহ (২০০০-২০০৩) দেশ-বিদেশের অসংখ্য বাণিজ্য সংগঠনের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর, ঠিক এই মুহূর্তে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার পেছনে আপনার মূল চালিকাশক্তি কী?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ: ধন্যবাদ। আমার ব্যবসায়িক এবং সাংগঠনিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিদ্ধান্তটি এসেছে। আমি মনে করি, এফবিসিসিআই শুধু একটি নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকার জন্য নয়। এর মূল শক্তি হলো এর সাধারণ পরিষদ সদস্যরা (জিবি মেম্বার), যারা দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চালিকাশক্তি। আমি গত ৯ মাস ধরে সারাদেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে উপলব্ধি করেছি যে, তাদের বিভিন্ন হয়রানি লাঘব এবং ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার জন্য একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন। আমার ব্যক্তিগত জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার মূল চালিকাশক্তি হলো একটি পরিবর্তন আনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আমি এফবিসিসিআইকে একটি সত্যিকারের সেবামূলক, গতিশীল এবং আধুনিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে চাই, যা প্রতিটি সদস্যের জন্য আস্থার প্রতীক হবে। শুধু নীতি নির্ধারণ নয়, নীতি বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা ও ক্ষেত্রবিশেষে সম্মিলিত শক্তিশালী একটি সংগঠন গড়ে তোলাই আমার লক্ষ্য।
প্রশ্ন ২: আপনার প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রে রয়েছে একটি ‘হয়রানিমুক্ত ওয়ান-স্টপ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠার ধারণা। এটি কি কেবল একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, নাকি এর কোনো বাস্তবসম্মত কাঠামো আপনি ভেবেছেন? সাধারণ ব্যবসায়ীরা এর থেকে ঠিক কীভাবে উপকৃত হবেন?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ: এটি কোনোভাবেই শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, এটি আমার কর্মপরিকল্পনার ভিত্তি। এর একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো আমি তৈরি করেছি। নির্বাচিত হলে আধুনিক এফবিসিসিআই ভবন নির্মাণ করার উদ্যোগ নিব । এফবিসিসিআই এ ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেলের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকবে। এই সেলটি কয়েকটি উইং-এ বিভক্ত থাকবে—যেমন: কাস্টমস ,ভ্যাট , আয়কর এবং বন্দর ।ব্যাংকিং ও অর্থায়ন । আমদানি-রপ্তানি, এবং আইনগত সহায়তা। ধরুন একজন সদস্য ব্যাংকের ঋণ পেতে বা বন্দরে পণ্য খালাস করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তিনি সরাসরি এই সেলে অভিযোগ জানাবেন। আমাদের সেলের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ দল তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি বুঝে নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি / বেসরকারী দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করবে। অর্থাৎ, সদস্যকে আর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না; এফবিসিসিআই তাঁর জন্য একটি ‘ব্রিজ’ বা সেতু হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের সময়, অর্থ এবং শক্তি বাঁচবে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই, কোনো ব্যবসায়ীকে যেন চাঁদা বা অনৈতিক সুবিধার জন্য হয়রানির শিকার হতে না হয়।
প্রশ্ন ৩: আপনার পারিবারিক পরিচয়টিও বেশ সমৃদ্ধ। আপনার প্রয়াত পিতা আলহাজ ডাঃ মোঃ রফিজ উদ্দিন ( সাকি মিয়া ) একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। আপনার মা রত্নগর্ভা সৈয়দা জেবুন নেসা রফিজ । আপনার সহধর্মিণী সৈয়দা শাহেদা পারভেজ ( রুমি ) একজন সফল উদ্যোক্তা এবং ১৮ বছর ধরে এফবিসিসিআইয়ের জিবি সদস্য। এই পারিবারিক উত্তরাধিকার আপনার নেতৃত্ব এবং দর্শনকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ: আমার বাবার হাত ধরেই আমার ব্যবসার শুরু ।আমার বাবা বেংগল বে গ্রুপ- এর চেয়ারম্যান ছিলেন । তার সততা ও পরিশ্রমই আমার মূল ভিত্তি। আমি ২০০০ সালে বাবার নামেই ‘রফিজ গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করি, যা আমার কাছে শুধু একটি ব্যবসা নয়, বাবার সততা, নিষ্ঠা এবং উত্তরাধিকার। অন্যদিকে, আমার সহধর্মিণী রফিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করেন । তিনি নিজেও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্য । আমাদের এখন ব্যবসার চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা, সংকট—এগুলো নিত্যদিনের আলোচনার বিষয়। এর ফলে আমি সমস্যাগুলোকে শুধু একজন নির্দিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি না, বরং সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করতে পারি। পারিবারিক শিক্ষাই আমাকে শিখিয়েছে যে, বড় শিল্পের পাশাপাশি মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখা কতটা জরুরি।
আমার দুই ছেলে । বড় ছেলে শাহ মোঃ জুনায়েদ পারভেজ বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। ছোট ছেলে শাহ মোঃ যেয়ান পারভেজ দেশে পড়াশোনা করছে।
প্রশ্ন ৪: দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। তাঁদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ : আমাদের দেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ নারী। তাঁদের অবদান জাতীয় উন্নয়নে অনস্বীকার্য ও প্রশংসনীয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ব্যবসা ও কর্মক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব এখনো পর্যাপ্ত নয়। আমি নির্বাচিত হলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য করব। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা কর্মসূচি চালু করব, যাতে তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়ে।
প্রশ্ন ৫: যুব সমাজকে কীভাবে দেশের উন্নয়নে যুক্ত করা যায়?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ : যুব সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা এখন সময়ের দাবি। যদি আমরা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে যুব সমাজ দেশের উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখতে পারবে। আমি চাই এফবিসিসিআই থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হোক, যাতে যুবদের উদ্যোক্তা বানানো যায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করা যায়।
প্রশ্ন ৬: আপনি দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘জটিল’ বলে মনে করেন। আপনার মতে, এই মুহূর্তে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো কী এবং সভাপতি নির্বাচিত হলে সেগুলো মোকাবিলায় আপনার কৌশল কী হবে?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ: প্রতিবন্ধকতা অনেক তবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে । এ প্রসঙ্গে আমি প্রধান কয়েকটি বিষয়ের কথা বলব।
প্রথমত, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা: মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির ব্যাংক লুটের কারণে পুরো খাতে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তার ভুক্তভোগী হচ্ছেন সৎ ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ঋণের সুদ বাড়ছে, ঋণ পাওয়া কঠিন হচ্ছে। আমার নেতৃত্বে এফবিসিসিআই সরকারকে ব্যাংক কমিশন গঠনে এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতে বলবে । আমরা সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে কাজ করব। এস এম ই ঋন যেন সহজে পেতে পারে সেই উদ্যোগ নেয়া ।
দ্বিতীয়ত, জ্বালানি সংকট ও নীতির সমন্বয়হীনতা: জ্বালানির অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয়হীনতা উৎপাদন খরচ আকাশচুম্বী করে দিয়েছে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। এফবিসিসিআই একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে সরকারকে জ্বালানি নিরাপত্তা এবং নীতি সমন্বয়ের জন্য একটি বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা দেবে।
তৃতীয়ত, কর ও শুল্ক সংক্রান্ত জটিলতা: কর ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি ব্যবসাবান্ধব নয়। অটোমেশনের অভাব এবং হাতে গোনা কিছু কর্মকর্তার কারণে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় নিরুৎসাহিত হন। তবে অধিকাংশ কর্মকর্তা সুন্দর কাজ করছেন।আমরা রাজস্ব বোর্ডের সাথে বসে কর ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল এবং হয়রানিমুক্ত করার জন্য কাজ করব। করের আওতা বাড়বে, হারের বোঝা কমবে—এটাই হবে আমাদের মূলনীতি।
প্রশ্ন ৭: পরিশেষে, সাধারণ পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী? কেন তারা একাধিক প্রার্থীর মধ্যে আপনাকেই তাদের নেতা হিসেবে বেছে নেবেন?
ড. পারভেজ সাজ্জাদ: আমার সাধারণ পরিষদ সদস্য ভাই-বোনেরা হলেন এফবিসিসিআইয়ের প্রাণ। আমি তাদের সম্মানেই এই কঠিন পথে নেমেছি। আমার বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট ও আন্তরিক: আপনারা দয়া বা মায়ার বশবর্তী হয়ে নয়, বরং বিবেক দিয়ে আপনার নেতা নির্বাচন করুন। আমার ৩৬ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা এবং ৩২ ব্যসর ব্যবসায়ী সংঘটনের সাথে সম্পর্ক রয়েছে পোর্ট ইউজারস ফোরাম থেকে শুরু করে শিপিং এজেন্টস এবং ফিশিং ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার রেকর্ড দেখুন। আমার সততা, নিষ্ঠা এবং কর্মঠ মনোভাবকে আপনারা মূল্যায়ন করুন। আমি আপনাদেরই একজন, একজন মাঝারি ব্যবসায়ী যে আপনাদের দুঃখ-কষ্টগুলো বোঝে। আমি কোনো অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না। আমি কথা দিচ্ছি, আমাকে যদি আপনারা একবার সুযোগ দেন, তবে এমন একটি এফবিসিসিআই রেখে যাব যা আপনাদের জন্য সত্যিই কাজ করবে, আপনাদের গর্বের কারণ হবে। আমি ছিলাম আছি এবং থাকবো ইনশাআল্লাহ ।আপনাদের সমর্থনে আমরা সফল হব। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।










