বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: স্যার এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের পর গত ৭২ বছরে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই চূড়ায় পা রেখেছেন। এভারেস্ট জয় নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য এক বিশাল অর্জন। কিন্তু হরি বুধা মাগারের জন্য এই অর্জন শুধুই একটি পর্বত জয় নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। ইতিহাসের পাতায় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি হাঁটুর ওপর থেকে দুটি পা হারানোর পরেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয় করেছেন।

গোয়ালঘর থেকে রণাঙ্গন
নেপালের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় গ্রাম মিরুলের এক গোয়ালঘরে জন্ম হরির। দারিদ্র্যের কশাঘাতে কাটে তার শৈশব। হরি বলেন, “আমি খালি পায়ে ৪৫ মিনিট হেঁটে স্কুলে যেতাম। আমাদের কাগজ ছিল না, কাঠের ফলকে পাথর দিয়ে লিখতাম। টয়লেট ছিল না, হাত দিয়ে খেতাম।”
তবে হরির চোখে ছিল বাবার দেখা এক স্বপ্ন। তার বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। বাবার সেই স্বপ্ন পূরণে ১৯৯৯ সালে, ১৯ বছর বয়সে ১২ হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ‘ব্রিগেড অফ গুর্খা’য় জায়গা করে নেওয়া ২৩০ জনের একজন হন হরি। প্রথমবারের মতো বিমানে চড়ে পাড়ি দেন ব্রিটেনে। এরপর কেনিয়া, ব্রুনেই, বসনিয়া, কসোভো সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই বিস্ফোরণ
২০১০ সালের এপ্রিল। আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশ। একটি ভোরের টহলে ছিলেন হরি। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ এবং ধুলোর ঝড়। একটি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসে (IED) পা পড়ে তার। মুহূর্তের মধ্যে তার ডান পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বাম পা মারাত্মকভাবে ঝুলে থাকে।
জ্ঞান ফেরার পর হরির প্রথম চিন্তা ছিল তার পরিবারকে নিয়ে। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বার্মিংহাম হাসপাতালে তার দুটি পা-ই হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়। এরপর শুরু হয় তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়।
হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো
পা হারানোর পর হরি গভীর হতাশায় ডুবে যান। তিনি বলেন, “আমি যে সমাজে বড় হয়েছি, সেখানে মনে করা হয় পঙ্গুত্ব হলো পূর্বজন্মের কোনো পাপের শাস্তি। আমি নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করতাম।” মদ্যপান আর বেদনানাশক ওষুধে ডুবে থেকে তিনি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু জীবনের মোড় ঘুরে যায় একটি স্কাইডাইভিং ইভেন্টে। ১৫ হাজার ফুট ওপর থেকে লাফ দেওয়ার সময় তিনি উপলব্ধি করেন, তিনি বাঁচতে চান। গুর্খাদের সেই বিখ্যাত মন্ত্র তার মনে পড়ে— “কাপুরুষের মতো বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।” তিনি বুঝতে পারেন, পা না থাকলেও তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন।
এভারেস্ট জয়ের লড়াই
সেনাবাহিনীর পুনর্বাসন কেন্দ্রে কৃত্রিম পা বা প্রোস্থেটিক্সের ব্যবহার শেখেন হরি। এরপর গলফ, স্কিইং, কায়াকিং এবং রক ক্লাইম্বিং শুরু করেন। কিন্তু তার মনের গভীরে সবসময় ছিল এভারেস্ট।
তবে এভারেস্ট জয়ের পথ মসৃণ ছিল না। ২০১৮ সালে নেপাল সরকার অন্ধ এবং পঙ্গু ব্যক্তিদের ৬,৫০০ মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বত আরোহণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হরি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে লড়াই করেন এবং ২০১৮ সালের শেষে জয়ী হন। এরপর তহবিল সংকট এবং করোনা মহামারির কারণে অপেক্ষা বাড়ে। অবশেষে ২০২৩ সালে তিনি এভারেস্ট অভিযানে নামেন।
চূড়ায় ওঠার মুহূর্ত
অভিযানটি ছিল ৬৪ দিনের। আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল। তুষারঝড়, হিমবাহ ধসে পড়ার ভয় এবং অক্সিজেনের ঘাটতি—সব কিছু উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে যান। হরি বলেন, “হিলারি স্টেপে পৌঁছানোর পর জানতাম, হয় ইতিহাস গড়ব, নয়তো মরব।”
বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে তিনি এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান। হরি বলেন, “চূড়ায় পৌঁছে আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। বেস ক্যাম্পে ফিরে এসেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি সত্যি এটা করেছি।”
নতুন লক্ষ্য
সম্প্রতি উইন্ডসর ক্যাসলে প্রিন্সেস অ্যান তাকে এমবিই (MBE) খেতাবে ভূষিত করেন। সেখানে হরি তার নতুন লক্ষ্যের কথা জানান— তিনি সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ সাতটি চূড়া (Seven Summits) জয় করতে চান। ইতিমধ্যেই তিনি অস্ট্রালেশিয়ার সর্বোচ্চ চূড়া কার্সটেনজ পিরামিড জয় করে ছয়টি শৃঙ্গ সম্পন্ন করেছেন। এখন তার লক্ষ্য অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট ভিনসন।
হরি বুধা মাগার আজ বিশ্বের ১.৩ বিলিয়ন প্রতিবন্ধী মানুষের প্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও মনের জোরে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তিনি বলেন, “বিপদ সবখানেই আছে। আপনি যদি সারাজীবন ভয় পেয়ে থাকেন, তবে কিছুই করতে পারবেন না।”









