Home Second Lead ‘সহজ’ হামলা, ভয়াবহ প্রভাব: অ্যান্টোনিয়া জাহাজ দুর্ঘটনায় নতুন সতর্কতা

‘সহজ’ হামলা, ভয়াবহ প্রভাব: অ্যান্টোনিয়া জাহাজ দুর্ঘটনায় নতুন সতর্কতা

ছবি সংগৃহীত

শিপিং ডেস্ক:

লোহিত সাগরের জেদ্দা বন্দরের দক্ষিণে এলিজা শোয়ালস এলাকায় কন্টেইনার জাহাজ এমএসসি অ্যান্টোনিয়ার সমুদ্রের তলদেশে আটকে যাওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে জাহাজটি ইচ্ছাকৃত জিএনএসএস (গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম) স্পুফিং বা জিপিএস বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় ঘনবসতিপূর্ণ জলপথে ইলেক্ট্রনিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

জাহাজটির এআইএস (অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম) এবং ট্র্যাকিং তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলের আগে এর গতিপথে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। উইন্ডওয়ার্ড, মেরিন ট্রাফিক ও পোল স্টার গ্লোবালসহ শীর্ষস্থানীয় সামুদ্রিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ঘটনাটি জিএনএসএস স্পুফিং অথবা জ্যামিংয়ের ফলেও ঘটতে পারে।

উইন্ডওয়ার্ড-এর অ্যানালিটিকস দেখায়, জাহাজটি যে ভিন্ন পথে চলে গিয়েছিল, তা স্পুফিংয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পোল স্টার গ্লোবাল নিশ্চিত করে যে, ভুয়া স্যাটেলাইট সংকেতের মাধ্যমে জাহাজের নেভিগেশন ব্যবস্থায় মিথ্যা অবস্থান তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতে ইসিডিআইএস (ইলেকট্রনিক চার্ট ডিসপ্লে অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম) নির্ভর নেভিগেশন দল বুঝতেই পারেননি যে তারা ভুল পথে চলেছেন।

২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে প্রকাশিত উইন্ডওয়ার্ডের সামুদ্রিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বলা হয় লোহিত সাগর ও গালফ অব এডেন এলাকায় স্পুফিংয়ের ঘটনা বেড়েছে। কিছু জাহাজের অবস্থান তথ্য ৬,৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হঠাৎ পরিবর্তিত হয়েছেযা স্বাভাবিক জিপিএস ত্রুটির গণ্ডির বাইরে।

এমএসসি অ্যান্টোনিয়ার এই দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিল, আধুনিক জাহাজ যতই প্রযুক্তিনির্ভর হোক না কেন, নেভিগেশনের নির্ভরযোগ্যতা আজ প্রশ্নের মুখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিপিএস নির্ভরতা কমিয়ে রাডার, ইনর্শিয়াল নেভিগেশন ও ভিজ্যুয়াল বেয়ারিংসহ একাধিক পদ্ধতি মিলিয়ে চলতে হবে, বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জলপথে।

স্পুফিংয়ের প্রকৃত উৎস এখনও নিশ্চিত না হলেও এটি বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপথে সাইবার ও ইলেকট্রনিক নিরাপত্তার বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

যদিও এমএসসি আনুষ্ঠানিকভাবে জিএনএসএস স্পুফিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেনি, তবে একাধিক স্বাধীন বিশ্লেষণে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, জাহাজের ভ্রান্তির অন্যতম কারণ ইলেকট্রনিক হস্তক্ষেপ। এমন ঘটনায় জাহাজ শিল্পের জন্য পজিশনিং সিস্টেমের প্রতিরক্ষা ও বহুমুখী যাচাইকরণ পদ্ধতি থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আবারও সামনে এলো।

লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী ও এমএসসি পরিচালিত অ্যান্টোনিয়া জাহাজটি সুদানের মার্সা বাশায়ের বন্দর থেকে সৌদি আরবের জেদ্দা বন্দরে যাওয়ার পথে আকস্মিকভাবে পথচ্যুত হয়ে অগভীর পানিতে আটকে পড়ে। দুর্ঘটনায় কেউ আহত না হলেও জাহাজটি এখনও আটকে আছে এবং টাগবোট দিয়ে তা উদ্ধারের প্রস্তুতি চলছে।

পোল স্টার গ্লোবালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রখ্যাত মেরিটাইম বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন স্টিভ বোমগার্ডনার জানিয়েছেন, জাহাজটির স্বয়ংক্রিয় অবস্থান শনাক্তকারী সিস্টেম ভুল তথ্য পেয়েছিল। জিপিএস স্পুফিংয়ের মাধ্যমে নকল উপগ্রহ সংকেত পাঠানো হয়, যা নেভিগেশন সিস্টেমকে বিভ্রান্ত করে ভুল অবস্থান দেখায়। এর ফলে নাবিকরা বুঝতেই পারেননি যে তারা বিপথে চলে যাচ্ছেন।

পোল স্টার গ্লোবালের বিশ্লেষণের সঙ্গে মেলে উইন্ডওয়ার্ড নামের মেরিটাইম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের আগের রিপোর্ট। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে
লোহিত সাগর ও আশেপাশের এলাকায় জিপিএস বিঘ্ন ঘটনার সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। জাহাজের অবস্থানে ‘লাফ’ বা আকস্মিক পরিবর্তনের পরিমাণ ৬ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে যেখানে ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল মাত্র ৬০০ কিলোমিটার।

৯ মে তারিখে ব্রিটিশ ইউকে এমটিও-ও জানিয়েছিল, লোহিত সাগর অঞ্চলে একাধিক জাহাজ জিপিএস বিঘ্নের মুখে পড়েছে। এসব তথ্য মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, এমএসসি এন্টোনিয়ার দুর্ঘটনাটি আকস্মিক নয়, বরং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের একটি অংশ।

ক্যাপ্টেন বোমগার্ডনার বলেছেন, “ঘটনাটি খুব জটিল না হলেও এর প্রভাব মারাত্মক। আজ হোক বা কাল, এমন কিছু যে ঘটবেই, তা আমরা অনুমান করেছিলাম।” তিনি জাহাজে থাকা সব নাবিক নিরাপদে থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

তিনি আরও সতর্ক করেছেন, ইলেকট্রনিক হুমকি মোকাবেলায় নৌ-শিল্পকে আরও সচেতন হতে হবে। জাহাজে শুধু জিপিএসের উপর নির্ভর না করে বিকল্প নেভিগেশন প্রযুক্তি চালু করা ও ক্রুদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।