Home আন্তর্জাতিক “বাণিজ্যিক সমুদ্রপথের শক্তি: এমএসসি আইরিনার অভূতপূর্ব ক্ষমতা

“বাণিজ্যিক সমুদ্রপথের শক্তি: এমএসসি আইরিনার অভূতপূর্ব ক্ষমতা

এমএসসি আইরিনা। ছবি সংগৃহীত

ফিচার প্রতিবেদন

কামরুল ইসলাম : বিশ্বের সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সক্ষমতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক পরিবহন সংস্থা এমএসসির মালিকানায়। এই জাহাজটির নাম এমএসসি “আইরিনা এবং এটি আধুনিক নকশা ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সমন্বয়ে নির্মিত একটি অভাবনীয় প্রকৌশল বিস্ময়।

২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাহাজটি এমএসসির বহরে যুক্ত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দ্য হুন্ডাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই জাহাজটির ধারণক্ষমতা প্রায় চব্বিশ হাজার তিনশ ছেচল্লিশ টিইইউ (  বিশ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারের সমতুল্য)  অন্যান্য সকল কন্টেইনারবাহী জাহাজের তুলনায় অনেক এগিয়ে রাখে।

এই জাহাজটির দৈর্ঘ্য প্রায় চারশো মিটার। অর্থাৎ প্রায় চারটি ফুটবল মাঠের সমান। প্রস্থ একশো মিটারের কাছাকাছি। জাহাজটি এতটাই দীর্ঘ ও প্রশস্ত যে, বন্দরে অবস্থানকালে একসাথে শতাধিক লরির সমপরিমাণ পণ্য ওঠানামা করানো যায়। বিশাল এই জাহাজটির গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৫.২ নটিক্যাল মাইল। এটি দ্রুত গতিতে মহাসাগর অতিক্রম করতে পারে।

এমএসসি ইরেস মূলত এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের মধ্যবর্তী রুটে চলাচল করে। সাধারণত এটি চীনের সাংহাই, দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান ও সিঙ্গাপুরের বন্দরে যাত্রা শুরু করে এবং মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপের রটারডাম, অ্যান্টওয়ার্প কিংবা হামবুর্গ বন্দরে পৌঁছে। এই রুটটি বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ হিসেবে বিবেচিত।

বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এমএসসি ইরেসকে ডিজেল-বিদ্যুৎ সংমিশ্রণচালিত প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়েছে। এতে রয়েছে উন্নত ধরণের স্ক্রাবার সিস্টেম, যা ধোঁয়া থেকে সালফার দূষণ কমিয়ে দেয় এবং সমুদ্রের পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই ব্যবস্থার ফলে জাহাজটি পরিবেশসম্মতভাবে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে সক্ষম।

বিশ্বের বৃহত্তম এই জাহাজ পরিচালনায় রয়েছে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নাবিকদল। জাহাজটিতে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় জিপিএস নেভিগেশন, স্বয়ংক্রিয় কন্টেইনার ম্যানেজমেন্ট এবং বিপদ সংকেত নির্ধারণের যন্ত্রাংশ সংযুক্ত রয়েছে। এই সকল ব্যবস্থার মাধ্যমে জাহাজটি প্রতিনিয়ত নজরদারির আওতায় থাকে এবং সমুদ্রপথে নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করে।

এমএসসি ইরেস শুধু আকারে বড় নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীকও বটে। প্রতিটি যাত্রায় এই জাহাজ প্রায় হাজার কোটি টাকার মালামাল পরিবহন করে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চক্রে গতি সঞ্চার করে। বিশেষ করে কোভিড মহামারির পর বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার পুনর্গঠনে এই ধরনের বৃহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বিশ্বের বাণিজ্যিক নৌপরিবহন খাত ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময়ের তুলনায় এখন আরো বড়, দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব জাহাজ তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমএসসি ইরেস তার বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এটি শুধু এমএসসির গর্ব নয়, বরং আধুনিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

ফলে বলা যায়, এমএসসির মালিকানাধীন এই বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ আধুনিক নৌপরিবহন জগতের একটি নতুন মাইলফলক। এর বিস্ময়কর আকার, প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধবতা এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব একে ভবিষ্যতের নৌযান ডিজাইনের পথপ্রদর্শক করে তুলেছে। উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংযোগ দৃঢ় করতে এই জাহাজ একটি নিরব বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে।