তরিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: হেমন্তের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। প্রকৃতিতে এখন উত্তুরে হাওয়ার দাপট। কুয়াশার চাদর মুড়ি দেওয়া শহরের অলস সকাল কিংবা মফস্বলের মিঠে রোদের দুপুর—শীতের এই আমেজের সঙ্গে যার সখ্যতা সবচেয়ে গভীর, সে হলো ‘কমলা’। জরাজীর্ণ প্রকৃতি যখন ধূসর হয়ে ওঠে, তখন ফলের দোকান বা হকারের ভ্যানে থরে থরে সাজানো উজ্জ্বল কমলা রঙ যেন চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।
কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে তখনই, যখন রসালো কোয়ার স্বাদ নিতে গিয়ে জিভে ঠেকে ভিন্ন স্বাদ, কিংবা খোসা ছাড়াতে গিয়ে নখ হয় নাজেহাল। দোকানি হাসিমুখে যা ‘কমলা’ বলে আপনার হাতে তুলে দিলেন, বাড়ি ফিরে দেখলেন তা আসলে ‘কিন্নো’। দেখতে যমজ ভাই-বোনের মতো হলেও, কমলা আর কিন্নো এক নয়। এই শীতে অলিগলি থেকে সুপারশপ—সর্বত্রই চলছে কমলা ও কিন্নোর এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা।
কমলা বনাম কিন্নো: আভিজাত্য বনাম সহজলভ্যতা
উদ্ভিদবিজ্ঞান বলে, আমরা যাকে ‘ম্যান্ডারিন অরেঞ্জ’ বা আসল কমলা বলি, তার আদি আভিজাত্য আলাদা। এর খোসা হয় ঢিলেঢালা, যেন গায়ে আলতো করে জড়িয়ে রাখা চাদর। একটু চাপ দিলেই খোসা খুলে বেরিয়ে আসে সুডৌল, রসালো কোয়া।
অন্যদিকে ‘কিন্নো’ হলো বিজ্ঞানের দান। ‘কিং’ এবং ‘উইলো লিফ’—এই দুই জাতের সাইট্রাস ফলের সংকরায়ণে (হাইব্রিড) জন্ম কিন্নোর। এর ফলন বেশি, দামও কম। আমাদের দেশে ভারত ও পাকিস্তান থেকে যে ‘কমলা’র চালান আসে, তার সিংহভাগই মূলত এই কিন্নো। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা বা অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে বিক্রেতারা কিন্নোকেই ‘উন্নত জাতের কমলা’ বা ‘ইন্ডিয়ান কমলা’ বলে চালিয়ে দেন।
ভোক্তা কীভাবে চিনবেন: আসল-নকলের ব্যবধান
কমলা কেনার সময় ঠকতে না চাইলে ভোক্তাকে হতে হবে সামান্য জহুরি। খুব সহজেই এই দুই ফলের পার্থক্য ধরা সম্ভব। চলুন দেখে নিই চেনার উপায়গুলো:
১. পোশাকের ভিন্নতা (খোসা):
আসল কমলার শরীরটা একটু এবড়োখেবড়ো হতে পারে, কিন্তু এর খোসা ফলের গায়ে খুব আলগাভাবে লেগে থাকে। হাত দিয়ে সামান্য চিমটি কাটলেই খোসা উঠে আসে। অন্যদিকে, কিন্নোর ত্বক খুব মসৃণ, টানটান এবং চকচকে। এর খোসা ফলের গায়ের সঙ্গে খুব শক্তভাবে (আঁটসাঁট) লেগে থাকে। হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলে খোসা ছিঁড়ে যায়, অনেকটা মাল্টার মতো ছুরি দিয়ে কাটতে হয়।
২. রঙের খেলা:
আসল কমলার রঙ সাধারণত একটু হালকা বা হলুদাভ কমলা হয়। অন্যদিকে কিন্নোর রঙ হয় গাঢ় কমলা বা টকটকে লালচে কমলা। কিন্নোর ‘গ্ল্যামার’ বা চাকচিক্য আসল কমলার চেয়ে বেশি। তাই চকচকে ফল দেখেই বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না।
৩. স্বাদ ও বিচির বিড়ম্বনা:
কমলার স্বাদ সাধারণত মিষ্টি হয় এবং এর কোয়াগুলো একে অপরের থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। অন্যদিকে কিন্নোর স্বাদ একটু কড়া, মিষ্টির সঙ্গে টকভাব বা ‘ট্যাঞ্জি’ ফ্লেভার থাকে। কিন্নোর সবচেয়ে বড় অস্বস্তির জায়গা হলো এর বিচি। একটি কিন্নোতে প্রচুর পরিমাণে বিচি থাকে, যা খাওয়ার আনন্দ কিছুটা মাটি করে দেয়। আসল কমলায় বিচি থাকে নামমাত্র।
৪. দাম ও স্থায়িত্ব:
বাজারে আসল কমলার (যেমন নাগপুরি বা দার্জিলিং কমলা) দাম কিন্নোর চেয়ে সবসময়ই বেশি থাকে। কিন্নো সস্তা এবং এর খোসা শক্ত হওয়ায় এটি দীর্ঘক্ষণ সতেজ থাকে, সহজে পচে না। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে কিন্নো পরিবহনে সুবিধাজনক।
ভোক্তার বয়ান ও বাজার পরিস্থিতি
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফল কিনতে আসা ব্যাংকার রাশেদুল ইসলাম বলেন, “বাচ্চারা কমলা খেতে পছন্দ করে। গত সপ্তাহে ‘কাশ্মীরি কমলা’ বলে যা কিনলাম, বাসায় গিয়ে দেখি খোসাই ছাড়ানো যায় না, ভেতরে রসে ভরা কিন্তু বিচিতে ভর্তি। পরে জানলাম ওটা আসলে কিন্নো। বিক্রেতারা সত্য বলে বিক্রি করলে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু কমলার দামে কিন্নো কেন কিনব?”
অন্যদিকে খুচরা ফল বিক্রেতা মতিন মিয়া বলেন, “স্যার, মানুষ চকচকে জিনিস খোঁজে। কিন্নো দেখতে সুন্দর, রসও বেশি। আসল কমলার দাম বেশি বলে সবাই নিতে চায় না। তাই আমরা কিন্নোই বেশি আনি।”
শীতের দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে বসে কমলা খাওয়ার সুখ বাঙালির চিরায়ত নস্টালজিয়া। কিন্নো বা কমলা—দুটোতেই রয়েছে প্রচুর ভিটামিন-সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। পুষ্টিগুণের বিচারে কিন্নো মোটেও ফেলনা নয়, বরং এর রসালো ভাব অনেকেরই পছন্দ। কিন্তু নাম ও দামের বিভ্রাটেই যত আপত্তি।
তাই পরের বার ফলের দোকানে গিয়ে যখন সেই চিরচেনা কমলা রঙের দিকে হাত বাড়াবেন, তখন একটু পরখ করে নেবেন—ওটা আলগা পোশাক পরা আভিজাত্যপূর্ণ ‘কমলা’, নাকি আঁটসাঁট বর্ম পরা চকচকে ‘কিন্নো’। ঠকবেন না, জেনেশুনে কিনুন, শীতের ফলের স্বাদ নিন ষোলোআনা।










