রামেশ ভট্টরায়, কাঠমান্ডু: নেপালের রাজনীতি যেন এক অন্তহীন অস্থিরতার কাহিনি। সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আবারও সামনে এসেছে অতীতের পুনরাবৃত্তি—দেশটির স্বাধীন রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থিতিশীল নেতৃত্বের বড় অভাব।
২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের পতনের পর নেপাল একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু নতুন সংবিধান, গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং বহুদলীয় অংশগ্রহণ—সবকিছুর পরও স্থায়ী রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি।
কেন এত ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন?
দলীয় বিভাজন ও জোট রাজনীতি
নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো—কংগ্রেস, সিপিএন (ইউএমএল), মাওবাদী কেন্দ্র—প্রতিনিয়ত ভাঙন ও পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে গেছে।
সংসদে কোনও দলই স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, ফলে জোট সরকার গড়তে হয়েছে বারবার।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত
দলীয় ভেতরের নেতৃত্ব সংকট, প্রাক্তন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক শক্তির টানাপোড়েন ক্ষমতা টেকসই হতে দেয়নি।
সংবিধান ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতা
২০১৫ সালের সংবিধান দেশকে ফেডারেল কাঠামো দিলেও অনেক সাংবিধানিক অস্পষ্টতা থেকে গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা সহজ হওয়ায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাহ্যিক প্রভাব
ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ভারত, চীন ও পশ্চিমা শক্তিগুলো নেপালের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে কোনও পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে অন্য পক্ষের চাপ বাড়ে।
প্রধানমন্ত্রীরা পূর্ণ মেয়াদে ব্যর্থ
২০০৮ সালের পর থেকে যারা নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন—পুষ্পকমল দাহাল ‘প্রচণ্ড’, মাধবকুমার নেপাল, ঝালা নাথ খনাল, বাবুরাম ভট্টরাই, সুশীল কৈরালা, কে.পি. শর্মা অলি, শেরবাহাদুর দেউবা—এরা সবাই রাজনৈতিক সমঝোতা বা অনাস্থা ভোটে মেয়াদের আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
- প্রচণ্ড প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাত্র ৯ মাসেই পদত্যাগ করেন সেনাবাহিনীপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে।
- অলি একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেও কখনো পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।
- দেউবা পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হলেও প্রতিবারই সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে ব্যর্থতার মুখে পড়েছেন।
জনগণের হতাশা
ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের ফলে—
উন্নয়ন প্রকল্পে ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়।
দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থা বেড়ে যায়।
জনগণের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আস্থা হারানোর প্রবণতা তৈরি হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
‘সেপ্টেম্বর বিপ্লব’ নামে পরিচিত সাম্প্রতিক আন্দোলন আবারও সেই অস্থিরতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। দেশজুড়ে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—নেপাল কি আবারও একই চক্রে বন্দি হতে যাচ্ছে, যেখানে সরকার বদলাবে, কিন্তু স্থায়ী নেতৃত্ব ও সুশাসন অধরাই থেকে যাবে?










