রামেশ ভট্টরায়, কাঠমান্ডু: রাজধানী কাঠমান্ডুর প্রধান পর্যটন এলাকা ঠামেল। সাধারণত ভরপুর থাকে ব্যাকপ্যাকার, ইউরোপ-আমেরিকার ট্রেকার, ভারতীয় পরিবার আর বাংলাদেশের তরুণ ভ্রমণপ্রেমীদের ভিড়ে। কিন্তু এবার সেখানে ঘুরে দেখা গেল ভিন্ন এক চিত্র। দোকানপাট খোলা, রঙিন পতাকা উড়ছে, তবু ক্রেতা নেই। হোটেলের লবিতে ঝুলছে “রুম অ্যাভেইলেবল” সাইনবোর্ড, অথচ বুকিংয়ের খাতা ফাঁকা।
হোটেল কেজিএইচ-এর প্রধান নির্বাহী রাজন শাক্য হতাশ কণ্ঠে বললেন,
“এই মৌসুমে সাধারণত ৭০ শতাংশ রুম ভরা থাকার কথা। এখন তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। একদিনেই আমরা ৩০০ বুকিং হারিয়েছি। শুধু হোটেল নয়—সবজির দোকান থেকে শুরু করে পাহাড়ের ট্রেকিং ট্রেইল পর্যন্ত প্রভাব পড়েছে।”
আন্দোলনের পর ধাক্কা
নেপালের পর্যটন বোর্ডের প্রধান দীপক রাজ জোশী স্বীকার করেন, পর্যটক আগমন কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। তিনি জানান, আন্দোলনের আগে প্রতিদিন যেখানে গড়ে ৩ হাজার ২০০ পর্যটক আসতেন, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ১ হাজার ৩০০-তে।
‘ভিজিট নেপাল ২০১১’-এর সমন্বয়কারী যোগেন্দ্র শাক্য যোগ করলেন, “সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আমাদের বুকিংয়ের অর্ধেক বাতিল হয়ে গেছে। অক্টোবরেও ২৫ শতাংশ বাতিল, আরও ২৫ শতাংশ স্থগিত।”
নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা
কাঠমান্ডুর এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসার পথে যাদের সঙ্গে কথা হলো, সবাই এক সুরে বললেন—ভয়টাই মূল সমস্যা। আন্দোলনের সময় ২৭টি কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দি পালিয়েছে। নাখু কারাগারের পোড়া গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিরাপত্তা কর্মী বললেন, “এখনও প্রায় সাড়ে সাত হাজার বন্দি বাইরে আছে। আমরা জানি না তারা কোথায়।”
নেপাল অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্টসের সভাপতি কুমারমণি থাপালিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
“হাজার হাজার অপরাধী বাইরে ঘুরছে, পুলিশের অস্ত্র লুট হয়েছে। পর্যটনের মৌসুম শুরু হয়েছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটছে না।”
ক্ষতিগ্রস্ত আতিথেয়তা খাত
বিক্ষোভকারীরা এক হোটেল ভাঙচুর করার পর হংকংয়ের ক্যাথে প্যাসিফিক সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত নেপালের সব ফ্লাইট স্থগিত করেছে। এতে সরাসরি ধাক্কা খেয়েছে আতিথেয়তা খাত। এক ট্রাভেল এজেন্ট জানালেন, বিদেশি ট্যুরিস্টদের রিফান্ড চাইতে হচ্ছে; অনেকে এখন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কার মতো বিকল্প গন্তব্য বেছে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সি গো-জায়ান জানিয়েছে, তাদের নেপাল ট্যুরের ৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল হয়েছে। ঢাকার ব্যবসায়ী মুঈদ ইবনে আহমেদ বলেন, “নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে ভ্রমণের আনন্দ থাকে না। তাই আমি সেপ্টেম্বরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছি।”
অর্থনীতিতে চাপ
পর্যটন নেপালের মোট জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ, প্রতিবছর আনুমানিক ৩০০ বিলিয়ন রুপি আয়। চাকরির ১০ শতাংশ নির্ভর করে এই খাতের ওপর। অথচ পরিস্থিতি এমন যে, কাঠমান্ডুর ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে পর্বতারোহী গাইড পর্যন্ত সবাই উদ্বেগে।
ঠামেল এলাকার এক দোকানি বললেন, “বিদেশিরা না এলে আমাদের ব্যবসা মরে যায়। প্রতিদিন দেখি, হোটেলগুলো খালি পড়ে আছে। আমরা শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করছি।”
তীর্থযাত্রী ও ট্রেকাররা ভিন্ন পথে
তবে সব খাত সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নয়। সহিংসতা কমার পরপরই তীর্থযাত্রা আবার শুরু হয়েছে। অক্টোবরেই সাত থেকে আট হাজার শ্রীলঙ্কান বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী কাথিনা পিঙ্কমায় অংশ নিতে আসবেন।
মানাসলু পর্বতে এই মৌসুমে তিনশ’র বেশি আরোহী অবস্থান করছেন। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মিংমা ডেভিড শেরপা বললেন,
“আমরা আরোহণ চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু বিশ্ব কেবল হোটেল পোড়ানোর ভিডিও দেখছে।”
নেপাল এখনও সৌন্দর্য, অভিযান আর আধ্যাত্মিকতার এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন, নিরাপত্তাহীনতা ও বুকিং বাতিলের স্রোতে পর্যটন খাত টালমাটাল। কাঠমান্ডুর সরেজমিন চিত্র বলছে যদি আস্থা ফেরাতে না পারে, তবে নেপালের অর্থনীতির অন্যতম ভরসা এই শিল্প আরও দীর্ঘ সময় ধুঁকতে থাকবে।