Home বিনোদন কুষ্টিয়ার বাউলপল্লি: যেখানে আজও বয়ে চলে সাধনার ধারা

কুষ্টিয়ার বাউলপল্লি: যেখানে আজও বয়ে চলে সাধনার ধারা

লালনের দেশে: পর্ব ৫

মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়ার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু নির্জন বাড়িঘর, যেগুলোর ভেতরেই বাস করে এক প্রাচীন সাধনাচর্চার উত্তরসূরিরা। তারা কারা? তারা হলো সেই বাউল সম্প্রদায়, যারা লালনের গানকে কেবল মুখে নয়, জীবনে ধারণ করে সাধনায় রত। এই মানুষগুলো চোখে পড়ে না শহরের আলোঝলমলে উৎসবে, দেখা মেলে না বড় কোনো মঞ্চে, কিন্তু তারা নীরবে বহন করে লালনের দর্শন।

কুষ্টিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট বাউলপল্লি গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে ছেঁউড়িয়া, হারিনারায়ণপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুর অঞ্চলে। এসব পল্লির বাউলরা নানা বয়সের, নানা পেশার হলেও তাদের এক সুতায় বাঁধা রেখেছে সাধনার পথ। কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউ ছোটখাটো হস্তশিল্পে যুক্ত, কিন্তু সন্ধ্যা নামলে তারা জড়ো হন একতারা হাতে, গানের সাধনায় মগ্ন হতে।

বাউলপল্লির জীবন সহজ, নিরাভরণ। তারা বিশ্বাস করেন, বাইরের চাকচিক্য নয়, ভেতরের জগতকেই শুদ্ধ করতে হয়। সেজন্য তারা লালনের গানের কথায় পথ খোঁজেন। অনেকেই বলেন, এই সাধনার জন্য প্রয়োজন আত্মিক অনুশীলন, দেহতত্ত্বে বিশ্বাস, আর সর্বোপরি আত্মজিজ্ঞাসা। তাদের মতে, গান গাওয়ার অর্থ আত্মাকে জাগানো, আর সেই আত্মা জাগে ধ্যান আর প্রেমে।

বর্তমানে বাউলপল্লির জীবন আগের মতো শান্ত নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে প্রবেশ করেছে নানা ধরনের সামাজিক চাপ, আর্থিক টানাপোড়েন, এবং মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। তথাপি, কিছু পরিবার এখনও একনিষ্ঠভাবে লালনের গান ও দর্শন রক্ষা করে চলেছে। তারা সন্তানদেরও সেই পথ শেখায়, যদিও তরুণদের একাংশ শহরমুখী হয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই মনে করেন, বাউলপল্লির বেঁচে থাকা মানে লালনের দর্শনের টিকে থাকা। কারণ গবেষক, পণ্ডিত, শিল্পী অনেকেই হয়তো লালনের গান নিয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু বাউলরা তা বাস্তবে জীবনযাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তারা গানকে জীবনের অঙ্গ হিসেবে নেন, নাড়ির মতো একে অনুভব করেন।

তবে এই পল্লিগুলোর অবস্থা এখন অরক্ষিত। সরকার বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে না বললেই চলে। মাঝে মাঝে কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় ঠিকই, কিন্তু তা অস্থায়ী। এদের জন্য প্রয়োজন একটি স্থায়ী সহায়তা কাঠামো, যাতে তারা নিরাপদে সাধনার জীবন চালিয়ে যেতে পারে।

আজ যখন শহরে বসে আমরা লালনের গান শুনে আপ্লুত হই, তখন মনে রাখা দরকার, সেই গান যারা বাঁচিয়ে রেখেছে, তারা ছড়িয়ে আছেন ছেঁউড়িয়ার গলি গলি পথে। তারা হয়তো নিরব, কিন্তু তাদের নিঃশব্দ সাধনার মধ্যে রয়েছে এক অমল আলো।


যারা সেই সাধনা ধারণ করে গানকে করে তুলেছেন মিলনের ভাষা, তাদের ঘিরে আছে এক উৎসব। পরবর্তী পর্বে পড়ুন—লালন স্মরণোৎসব: মিলনমেলা না পর্যটন উৎসব, শুধুমাত্র বিজনেসটুডে২৪.কম–এ।