বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চাঁদপুর: চাঁদপুরের কৃষি মূলত ধান, সবজি, ফল এবং নদীনির্ভর পল্লী অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। জেলার চারটি উপজেলায় বিস্তৃত উর্বর জমি এবং নদীর পলির কারণে উৎপাদনক্ষমতা তুলনামূলক বেশি হলেও কৃষকরা নানা সমস্যার মুখে পড়ছেন। বাজারে দামের ওঠানামা, সেচব্যবস্থার ব্যয় এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার সীমাবদ্ধতা অনেক পরিবারকে কৃষিভিত্তিক আয় থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
চাঁদপুরে ধান উৎপাদনই কৃষির প্রধান স্তম্ভ। স্থানীয় কৃষকদের দাবি, উৎপাদন বাড়লেও লাভ কমে যাচ্ছে। কারণ বাজারে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ, মিলারদের অগ্রাধিকারমূলক দামের চাপ এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি কৃষকের ঘরে পড়ে। অনেকসময় মৌসুমে ধানের দাম উৎপাদন ব্যয়ও ছাড়িয়ে উঠতে পারে না। সরকারি ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ বাড়ানো তাদের দাবি।
চাঁদপুরের সবজি উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য। শীতকালীন মুলো, বেগুন, শসা, ধনিয়া, লাউ, টমেটোসহ নানা সবজি জেলা থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও আশপাশের বাজারে সরবরাহ হয়। কিন্তু কৃষকের প্রধান সমস্যা হলো মধ্যস্বত্বভোগীর আধিপত্য। উৎপাদন কেন্দ্রে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অনেক কৃষক পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জন করতে পারেন না। পরিবহনব্যবস্থা উন্নত হলে এবং স্থানীয় হাটবাজারের আধুনিকীকরণ হলে এই খাত আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ফল উৎপাদনে চাঁদপুরের সম্ভাবনা বাড়ছে। বিশেষ করে কলা, পেয়ারা, আমড়া, লেবু এবং কাঁঠালের উৎপাদন প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ফলচাষিরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ফল সংগ্রহের সময় অনিশ্চয়তা বেড়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টি বা অকাল শিলাবৃষ্টিতে ফল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। সেচব্যবস্থায় সৌরশক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ কমানো গেলে ফল উৎপাদন আরও লাভজনক হবে।
ইলিশনির্ভর পল্লী অর্থনীতি চাঁদপুরে কৃষির পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নদীকেন্দ্রিক এই জীবনযাত্রা অনেক পরিবারকে আয় দেয় বটে, তবে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কৃষিকাজই তাদের প্রধান ভরসা হয়। অনেকে নদীতে মাছ ধরা কমিয়ে শাকসবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছেন। এভাবে কৃষি ও মৎস্য অর্থনীতি পরস্পরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।
প্রযুক্তি ব্যবহার কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। চাঁদপুরে ধীরে ধীরে কম্বাইন হারভেস্টার, পাওয়ার টিলার, বীজতলা যন্ত্র এবং সোলার সেচপাম্প ব্যবহার বাড়ছে। তবে যন্ত্রের দাম, প্রশিক্ষণের অভাব এবং সহজ ঋণ সুবিধার অভাব এই অগ্রগতিকে ধীর করছে। কৃষকরা চান স্বল্পসুদে ঋণ, যন্ত্রপাতি ভাড়া কেন্দ্র এবং আধুনিক কৃষি প্রশিক্ষণের সুযোগ।
অন্যদিকে জমির উর্বরতা রক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। নদীর ভাঙন, অনিয়মিত পলি জমা, জলাবদ্ধতা এবং কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার কৃষিতে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টেকসই কৃষি প্রথা, জৈব সার ব্যবহার, মাটি পরীক্ষা এবং পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে চাঁদপুরের কৃষি আরও শক্তিশালী ও লাভজনক খাতে পরিণত হতে পারে।
সর্বোপরি, চাঁদপুরের কৃষি উন্নয়নে বাজারস্বচ্ছতা, প্রযুক্তিগত সহায়তা, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো এখন সময়ের দাবি। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে চাঁদপুর কৃষিতে একটি মডেল জেলায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।










