Home অন্যান্য সুশান্তর শেষ স্টপেজ

সুশান্তর শেষ স্টপেজ

 ছোট গল্প

কৌশিকরঞ্জন খাঁ

বাসস্ট্যান্ড থেকে জানালার পাশের স্টাফ সিটেই বসে আসছে গৌরী। সামনে দরজা। স্পেস এবং হাওয়া এন্তার। পাবলিকের গুঁতোগুঁতি নেই। নামার সময় হ্যাপাও কম। সিট থেকে উঠে টুক করে নেমে পড়ো।

অফিস টাইমের বাস। স্বাভাবিক ভাবেই তা ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের দখলে থাকে। পাঁচশো মিটারের মাথায় প্রথম স্টপ। একটি মলে দম্পতির সাজে একজোড়া মেল-ফিমেল ম্যানেকুইন। সেদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে, প্রণীত উঠে আসছে হাতের সিগারেটে শেষ টান মেরে। কনডাক্টরের সিটে বসা গৌরীকে আড়চোখে দেখে নিয়ে একটা মৃদু হাসি হেসে ঝুল সামলে ডান দিকের তিন নম্বর জানালার পাশের সিটে বসে। আজ অন্যদিনের মতো নয়। একটু গম্ভীর। আঘাত খেয়ে সামলে ওঠা মুখ নিয়ে বসে।

পিছনের দিকে একটা টু–সিটে পাশাপাশি বসেছে শুভম–প্রচেত। মোবাইল স্ক্রল করতে দুজনেই ব্যস্ত। দশটা পাঁচের ইটাহারগামী বাসটি এগিয়ে চলে। পাওয়ার হাউস স্টপ থেকে আরেকজন উঠত– সুশান্ত। সেই সুশান্ত আজ উঠবে না– একথা ভাবতেই গৌরীর মুখের সানস্ক্রিন লোশনের নীচে একটা বেদনা ছড়িয়ে যায়। একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। চির বিতর্কিত, চির বোহেমিয়ান সুশান্ত আর তাদের সহযাত্রী হবে না কোনওদিন।

তাকে আর কোনওদিন পাওয়া যাবে না মেনে নিয়েই এগিয়ে চলছে সকাল দশটা পাঁচের ইটাহারগামী ‘সোনালি–মৌসুমী’। স্কুলে না গেলে সুশান্ত বাসে ওঠেনি বা লেট করলে পরের বাসে গিয়েছে। কিন্তু আজ সে সমস্ত সম্ভাবনাই বৃথা করে দিচ্ছে!

ছোট রঘুনাথপুর থেকে ওঠে শহরের শেষ ডেইলি প্যাসেঞ্জারের ট্রুপ। অন্যদিন গৌরী ইশারায় দেখিয়ে দেয় ফাঁকা সিট। আজ ভাবলেশহীন ও অন্যমনস্ক। মুনমুন সরকার- যে বাসের নিত্যযাত্রীদের কাছে ‘মুনদি’, প্রায় সমবয়সিদের মধ্যে বয়স, চাকরিজীবন, অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বে এগিয়ে থাকার কারণে, খুব ধীরস্থির ভাবে বাসে ওঠে। এতটাই ধীরে যে বাসের খালাসিকেও বলতে হয় ‘তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!’ বাসের খালাসি জানে না আজ এরা সবাই শ্লথ। একে একে অভ্রতনু, পিয়াল, মৌলি– সবাই ওঠে। কারও মুখে কথা নেই, বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আগের আলোচনার কোনও পুরোনো সূত্র নেই। যেন এক-একটি যন্ত্র উঠছে। শুধু কাল বিকেলে সুশান্তর বডি প্রত্যর্পণের পর ওরা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ডেইলি প্যাসেঞ্জার বৈদ্যুতিক চুিল্লর দরজাটা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে ছিল।

মুনমুন বাসে উঠে গম্ভীরমুখে চারিদিকে তাকিয়ে নেয়। বেশ কয়েকটি সিট খালি আছে। সে ফাঁকা সিটের কাছে এগিয়ে যায়। একটা সাদা টাওয়েল পেতে দেয়। সিটে একটা রজনীগন্ধার মালা ঝুলিয়ে দেয়, রাখে কয়েকটা সাদা গোলাপ।

কনডাক্টর পরিচিত। তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে– ‘আজ সুশান্তের স্মৃতিতে এই সিট খালি থাকুক, ভোলাদা। পরিবর্তে আমি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি।’

ভোলা একমুখ জর্দাপানে লাল মুখ নেড়ে বলে, ‘ফাঁকা সিট তো আছেই। আপনি বসুন না দিদিমণি।’

মুনমুন থমথমে মুখে জানালার কাচে চোখ রাখে। চোখের পলক ফেললে বা এদিক থেকে ওদিকে নাড়ালেই বোধহয় টপ করে জল পড়ে যাবে। ছেলেবেলার অবাক করা দৃশ্যের মতো বাস একই জায়গায় থাকছে, শুধু গাছপালা-বাড়িঘর পিছনে চলে যাচ্ছে। মুনমুনের চেয়ে বয়সে অনেক অনেক ছোট সুশান্ত। ভাইয়ের চেয়েও ছোট, ছেলের চেয়ে ক’বছরের বড়। এত অল্প বয়সে সুশান্তের হঠাৎ চলে যাওয়ায় সে রুদ্ধবাক। জয়েনিংয়ের পরদিন, যেদিন সুশান্ত নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল, সেদিনই অচেনা বাচ্চা ছেলেটাকে পাশের সিটে বসিয়ে বলেছিল– ‘প্রাইমারিতে জয়েন করেছিস! কোন স্কুল?’

সমস্ত বাসটা একটা দুঃখের বাম্পারের উপর দিয়ে যেতে গিয়ে যেন ঝাঁকি দেয়। থিতিয়ে রাখা কষ্ট নড়েচড়ে ওঠে। কনডাক্টর ভাড়া চাইতে এসে প্রণীতকে বলে, ‘শুনেছিলাম বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ ছিল, শেষপর্যন্ত মরেই গেল! এ বাসে প্রায় বারো বছর ধরে যাচ্ছিল।’

প্রণীতের মনে সুশান্তর মুখটা ভেসে ওঠে। ইস! এক সপ্তাহ আগেও, তাকে দেখা শেষ দিনে, সে প্রণীতের পাশেই বসেছিল। ইদানীং কথা কম বলছিল। চোখে সবসময় সানগ্লাসটা রাখত। কেন কে জানে!

প্রণীত যখন সুশান্তর কথা ভাবছে ঠিক তখনই গৌরী বলে ওঠে– ‘প্রণীতদা, তুমি লক্ষ করেছ, ইদানীং সুশান্ত চোখে সবসময় সানগ্লাস পরে থাকত।’

প্রণীত কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সদ্য চাকরি পাওয়া নন্দিনী উত্তর দেয়, ‘নিশ্চয়ই খুব দুঃখ ছিল মনে। চোখে তো সেটা ফুটে ওঠে, তাই।’

মাঝরাস্তায় একজন উঠে খালি সিট দেখে এগিয়ে গিয়ে থমকে যায়। আশপাশের সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এখানে কেউ বসবে না?’

কনডাক্টর ভোলা এগিয়ে এসে বলে, ‘আমাদের একজন ডেইলি প্যাসেঞ্জার মারা গিয়েছে। সিটটা খালিই থাকুক। নাহলে তো দিদিমণিই বসতেন। পেছনে সিট খালি আছে। আপনি ওদিকে গিয়ে বসুন।’

পরাণপুর থেকে ওঠা দুই দিদিমণি ঠিক চিনতে না পেরে প্রশ্ন করে, ‘কে ভোলাদা? আমরা চিনতাম?’

-হ্যাঁ, চিনতেন। সুশান্ত মাস্টারমশাইয়ের পাশে বসে আপনারাও কতদিন গেছেন।

দিদিমণি দুজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মনে করার চেষ্টা করে। কূলকিনারা না পেয়ে একজন বলে, ‘ওহ‌! পেপারে পড়লাম যে সুশান্ত দাসের খবরটা! তিনিই না? ইস, ভাবা যায় না! সুস্থ সবল মানুষ নদীর জলে ভেসে গেল কীভাবে?’

ভোলা তাদের পয়সা ফেরত দিতে দিতে বলে, ‘হ্যাঁ। তবে কী! আজকাল মাস্টারমশাই বদলে গেছিল। একা-একা চুপচাপ যেত। মুখে কতদিন গন্ধ পেয়েছি। আপনারা টের পেয়েছেন কি না জানি না! বাসস্ট্যান্ডে খুব ডিয়ার লটারি কাটত। সবই আমরা দেখতাম। এই করে মার্কেটে অনেক দেনাও হয়ে গেছিল। গত কয়েকমাস ধরে রেগুলার স্কুলেও যেত না।’

ভোলার কথা কেড়ে নিয়ে প্রণীত বলে, ‘একা হয়ে পড়ছিল। আগের বন্ধুবান্ধব কেউ ছিল না। সবাই সরে পড়ছিল। যদি বন্ধুরা ঘিরে থাকত, তাহলে বোধহয় এই পরিণতি হত না!’

গৌরী মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। কথার শেষে মন্তব্য করে, ‘আসলে আমাদের থেকে তো ও অনেকটা ছোট। আমরা কেউ দিদি, কেউ দাদা। প্রতিদিন অনেকটা সময় কাটালেও, আফটার অল আমরা ওর বন্ধু হতে পারিনি। তাই আমাদের সামনে নিজেকে গুটিয়ে নিত।’

প্রণীত কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে গৌরীকে বলে, ‘একটা ছেলে একটু একটু করে তলিয়ে গেল জীবনের সমুদ্রে। কোথায় আমরা তাকে ঘিরে ধরে বাঁচাব! তা নয়, একা-একা ছেড়ে দিলাম। কেউ পাশে থাকলাম না। সুশান্ত তো পার্টি করত সক্রিয়ভাবে। তারাও…’

গত বছর দুয়েক নিয়মিত ছিল না। যুব সংগঠন করত। অনিয়মিত যোগাযোগের কারণে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আসলে ঘনিষ্ঠতা না থাকলে কোনও পার্টি আর কবে কাউকে মনে রাখে? পুরোনো শ্রমের কোনও দাম থাকে না পার্টির কাছে।

কনডাক্টর অন্যদিকে চলে গেলে প্রণীত বলে, ‘আমরা তো শুধু বাসের পরিচিত নই। সেই বেসিক ট্রেনিং থেকে একসাথে। চাকরি একসাথে, এক জায়গায়। একটু রাগী টাইপের ছেলে হলেও মনটা ছিল একেবারেই সরল। কাউকে সাহায্য করতে নিজের কথা কোনওদিন ভাবত না। করোনার সময় সুশান্ত রাতবিরেতে কত অসুস্থ লোককে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়েছে। কত লোককে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। মনে আছে!’

-মনে আছে। কিন্তু ভুলে গেছিলাম। মানুষ ভালো জিনিস মনে রাখে না, প্রণীতদা। সুশান্তের মুখে মদের গন্ধ পাওয়া যেত, লটারি কেটে নিঃস্ব– মানুষ এখন এটাই মনে রেখেছে। শুনলে না?’

একটা ধারাবাহিক স্মৃতিচারণা চলতে থাকে। গৌরী, প্রণীত, মুনমুনের কথাগুলো বাসের কিছু যাত্রী নিবিষ্ট মনে শুনতে শুনতে এক সূত্রে বাঁধতে চেষ্টা করে। সুশান্তকে নিয়ে একটা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হয়ে গেছে।

মুনমুন আত্মগ্লানিতে বলে, ‘আমাদেরই ভুল হয়েছে বুঝলি। সুশান্ত এমন হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সবাই কমবেশি জানতাম। অথচ কেউ ওকে একটুও সময় দিলাম না। কেউ খোঁজ নিলাম না। নিজেদের নিয়েই মশগুল থেকে গেলাম। এর কোনও মাফ হয় না ভাই।’

রঞ্জিতা নামে মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে বসেছিল ড্রাইভার’স কেবিনের সিটে। ছোট্ট বাসটার সব কথা তার কানে আসছিল। আজকের দিনে তাকে কেউ লক্ষ করছে না। কিন্তু সে জানে সুশান্তের এই পরিণতির কারণ। বাসের অনেকেই জানে, একসময় সুশান্ত আর রঞ্জিতার মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শহরের রেস্তোরাঁ, ক্যাফেতে তাদের দেখা গিয়েছিল একসময়। সুশান্ত হাঁটছে শহরের গলিতে, রঞ্জিতা পাশে পাশে।

হাঁটতে হাঁটতে, ঘুরতে ঘুরতে তারা পরস্পরের কাছাকাছি এসে দেখেছিল– অনেক অনেক মাইল দূরত্ব। রঞ্জিতা শাসকদলের নেতার মেয়ে, সুশান্ত সেই দলের বিরুদ্ধে মিছিল করে, পতাকা বাঁধে। এটুকু অনেকের কাছে বাধা হয় না। অনেকের কাছে রাজনীতি সময় কাটানোর জায়গা অথবা ক্ষমতার পাশে থাকা। সুশান্ত এমন এক বিশ্বাস থেকে রাজনীতি করত যেখানে চাওয়াপাওয়ার চাইতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার তাগিদ বেশি। ফলে সাড়ে সাত লাখ টাকায় চাকরি কেনা রঞ্জিতার সাথে এককথা দু’কথাতেই সংঘাত বেধে যেত।

সুশান্তর সাথে বিচ্ছেদের পর রঞ্জিতার ছেলের অভাব হয়নি। মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ায় পারদর্শী কতজন লাইন দিল। সে সব দেখতে দেখতে সুশান্ত ক্রমশ এক ঘৃণার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিল। এর থেকে মুক্তি খুঁজতে খুঁজতে নেশার নিষিদ্ধ জগতের গলিঘুঁজি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। শহরের সমস্ত সস্তা মদের ঠেক তার কাছে পরিচিত হয়ে উঠছিল। সে পরিচিত হয়ে উঠছিল অন্ধজগতের সমস্ত নেশাখোর ও জুয়াড়িদের কাছে। তখন রঞ্জিতার বলা সহজ হল, ‘বেহেড মাতালের সাথে প্রেম করা যায়!’

মদ ও জুয়া নিয়ে সুস্থ জীবনের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সুশান্তর বেতন কম পড়ে যাচ্ছিল। মদ খেলেই বমির মতো উগরে দিত ভেতরের জ্বালা। ফলে সস্তা মদের দোকানের সঙ্গীরা তাকে কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছিল। সুশান্তের মতো তারাও নিজের পকেট উজাড় করে ত্রিসন্ধ্যা মদ খাওয়াত। তাদেরই একজন বাস কনডাক্টর ভোলা। সে জানে মাস্টারমশায়ের মুখে গন্ধ থাকলেও মনে ফুটে থাকত গন্ধরাজ।

তবুও ভোলা ভাড়া কাটতে কাটতে একবারও ঘৃণা কিংবা রাগ নিয়ে রঞ্জিতার দিকে তাকায়নি। কনডাক্টরের যা কর্তব্য সেই কর্তব্য পালন করেছে। যখন রঞ্জিতার কাছ থেকে অন্য যাত্রীদের কাছে চলে যাচ্ছিল তখন ফিশফিশ গলায় শুনল, ‘দাদা, জলে ডুবেই মারা গেল! মানে আত্মহত্যা?’

-ঠিক জানি না দিদিমণি। বাসস্ট্যান্ডে তো নানা জনে নানা কথা বলছে। কেউ আত্মহত্যা বলছে, কেউ বলছে টাকার জন্যে মার্ডার। বডি তো বাংলাদেশে ভেসে গেছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বাংলাদেশ পাঠাবে।’

বাসের সবাই হাঁ হয়ে কনডাক্টরের কথা গিলছিল। মুনমুন স্বগতোক্তি করে বলে, ‘ইশ! ছেলেটা যা খুশি ভাবে জীবন কাটাল। মারা যে গেল! তাতেও রহস্য। কেউ কোনওদিন ভেবেছিলাম– এভাবে একদিন বাসে সুশান্তকে ছাড়া যেতে হবে? হঠাৎ করে কোথায় চলে গেল, আর ফিরল না, তারপর তার পোস্টমর্টেম করছে অন্য একটা দেশ।’

‘ও মুনদি!’ গৌরী চোখে জল নিয়ে বলে, ‘কত কিছু শুনেছি। সুশান্ত রাফ ছেলে, নেশা-ভাং করে, কিন্তু মেয়েদের কি অসম্ভব রেসপেক্ট দিত, না?’

-হুঁ।

মদ খেয়ে থাকলে সুশান্ত কথা বলত না। চুপ করে সিটে বসে থাকত ঘুমের ভান করে। স্কুল এলে কোনও দিকে না তাকিয়ে মাথা নীচু করে নেমে যেত।

রাধানগর থেকে ওঠা পম্পা বলে, ‘একদম, গৌরী একদম ঠিক বলেছে। সামনে কোনও মহিলা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখলে, সুশান্তকে কত-কত দিন সিট ছেড়ে দিতে দেখেছি।’

এতক্ষণ চুপ থাকা দোলা পেছন থেকে বলে, ‘জায়গা না পেলে সুশান্ত যদি দেখে ফেলত জোর করে সিট ছেড়ে দিয়ে বসাত। তোদের কথা শুনতে শুনতে কত কথা মনে পড়ছে রে।’

প্রণীত আক্ষেপ করে, ‘শুধু আজ চর্চা হচ্ছে ওকে নিয়ে। কাল থেকে সবকিছু বদলে যাবে দোলাদি। আমরা অন্য বিষয়ে কথা বলব। সুশান্ত বলে আর কোনও ভাই-বন্ধু-ডেইলি প্যাসেঞ্জার থাকবে না।’

মুনমুন বলে, ‘সত্যিই রে! মানুষ চলে গেলে সবকিছু নিয়ে চলে যায়। আর কিচ্ছু থাকে না।’

বাস মৃদুগতিতে ছুটছে। খাঁড়ির উপরের ছোট্ট ব্রিজটা পেরোলে সুশান্ত তার যাবতীয় ঘুম, সাম্প্রতিক কালের নীরবতা ভেঙে নড়েচড়ে বসত। আর মাইল তিনেক পরেই ‘মালাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সুশান্ত উঠে গেটের কাছে গেলে খালাসির হাত বেলের দড়িটা ধরত।

আজও আকাশমণি ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গল পেরিয়ে যেতে যেতে সূর্যের আলো গায়ে মেখে উঁকি দিচ্ছে প্রাচীর ঘেরা একতলা স্কুলবাড়িটা। মাঝারি মাপের লোহার গেট। আহা! সুশান্তের স্পর্শ লেগে আছে। আজ সুশান্ত নামবে না। বাসের ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা জানে আজ বাস থামবে না।

মালাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে খালাসি টুং করে বেল বাজিয়ে দিল। ড্রাইভার কোনও যাত্রী নামবে না জেনেও বাস থামিয়ে দিল। সুশান্তের নামতে যতটুকু সময় লাগত, ঠিক ততটুকু সময় বাসটা আজও থেমেছিল। ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে দু’সেকেন্ডের নীরবতা। একটা শোক-শোক সভা।

-সংগৃহীত