হেলথ ডেস্ক:
একটা সময় ছিল, যখন মিষ্টিজাতীয় খাবার মানেই ছিল উৎসব, অতিথি আপ্যায়ন কিংবা জন্মদিনের কেক। এখন সেসব পেছনে পড়ে গেছে। আজকের দিনে চিনি আমাদের খাদ্য তালিকার নিত্য সঙ্গী। চায়ের কাপ থেকে শিশুদের ইয়োগার্ট প্রায় প্রতিটি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যেই চিনি ঢুকে পড়েছে নিরবে, নিঃশব্দে। তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, এই চিনি সবসময় চোখে দেখা যায় না। আর এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও খাদ্য বিশেষজ্ঞ টিম স্পেকটর বলেন, কমলার রসও নাকি কোল্ড ড্রিংকের মতোই ক্ষতিকর। সেই সঙ্গে বিতর্ক ছড়ায় প্রেট এ মাঞ্জের গ্রানোলা ব্রেকফাস্ট বোলগুলো নিয়ে, যেখানে শর্করার মাত্রা একটি মার্স চকলেট বারের চেয়েও বেশি। এমনকি শিশুদের জন্য প্রস্তুত ‘হেলদি’ ইয়োগার্ট পটগুলোও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এক প্যাকেট হারিবো ক্যান্ডির চিনি পরিমাণ!
কোন চিনিতে কতটা ক্ষতি?
খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনির দুটি ধরন রয়েছে ইনট্রিনসিক (স্বাভাবিকভাবে উপস্থিত) ও ফ্রি সুগার (প্রক্রিয়াজাত বা যোগ করা চিনি)। ফলমূল, সবজি ও দুধে থাকা স্বাভাবিক চিনি শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং সমস্যার মূল হচ্ছে ফ্রি সুগার, যা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বের করে নেওয়া হয়—যেমন ফলের রস, পিউরি, মধু কিংবা সিরাপ। এগুলো শরীরে দ্রুত শোষিত হয়, রক্তে চিনি বাড়িয়ে দেয় হঠাৎ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
কতটুকু চিনি গ্রহণ করা নিরাপদ?
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের সুপারিশ অনুযায়ী, ১১ বছর বয়সী শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিনের ফ্রি সুগার গ্রহণ সীমা ৩০ গ্রাম। অথচ বাস্তবে ব্রিটেনসহ অনেক দেশে গড়ে মানুষ এর দ্বিগুণ চিনি গ্রহণ করে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিশেষজ্ঞ ভ্যালেরিয়া ফোলকো বলেন, “অতিরিক্ত চিনি দাঁতের ক্ষয়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং ওজন বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দেয়। রক্তে চিনি ওঠানামা করায় দেহে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা আলঝেইমার থেকে শুরু করে হৃদরোগ এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।”
চিনি লুকিয়ে থাকে কোথায়?
চিনির বড় বিপদ হলো, এটা সবসময় নাম ধরে আসে না। লেবেলে লেখা থাকে গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, ডেক্সট্রোজ, সিরাপ, মোলাসেস, বা জুস কনসেন্ট্রেট, যারা প্রত্যেকেই ফ্রি সুগার। এমনকি ‘নো অ্যাডেড সুগার’ লেখা পণ্যে প্রাকৃতিক চিনি যেমন ফলের পিউরিও থেকে যায়।
নিউট্রিশন লেবেল পড়ার সহজ কৌশল: “কার্বোহাইড্রেটস, অফ হুইচ সুগারস” অংশ দেখুন। যদি প্রতি ১০০ গ্রামে ২২.৫ গ্রাম বা তার বেশি চিনি থাকে, সেটি উচ্চমাত্রার চিনি হিসেবে বিবেচিত হবে।
কমলার রস বনাম কোলা: কোনটি ভালো?
প্রফেসর স্পেকটরের কথায় আলোড়ন উঠলেও, পুষ্টিবিদরা বলছেন, কমলার রস আর কোল্ড ড্রিংককে এক কাতারে ফেলা ঠিক নয়। ২৫০ মিলিলিটার কোল্ড ড্রিংকে থাকে প্রায় ২৭ গ্রাম ফ্রি সুগার এবং ক্যাফেইন। বিপরীতে ১৫০ মিলিলিটার কমলার রসে থাকে প্রায় ১২ গ্রাম চিনি, কিন্তু সেই সঙ্গে ভিটামিন সি ও অল্পমাত্রায় ফাইবারও পাওয়া যায়।
চকলেট না ইয়োগার্ট: কোনটি শিশুর জন্য ভালো?
অনেক শিশুদের জন্য তৈরি ইয়োগার্টে থাকে ৮-৯ গ্রাম ফ্রি সুগার, সাধারণত ফলের পিউরি বা কনসেন্ট্রেট হিসেবে। তবে এর সঙ্গে থাকে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও অনেক ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি-ও। তাই এগুলো একেবারে বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী নন পুষ্টিবিদরা। বরং বলা হচ্ছে, চকোলেটের চেয়ে এগুলো তুলনামূলক নিরাপদ।
তবে সাবধান থাকতে হবে আলট্রা প্রসেসড ফ্লেভারড ইয়োগার্ট যেমন ফ্রুবসের মতো ব্র্যান্ড থেকে, যেগুলোতে প্রচুর স্ট্যাবিলাইজার ও ফ্লেভারিং থাকে।
প্রেট-এর গ্রানোলা বোল: ‘হেলদি’ নাকি বিভ্রান্তি?
প্রেট-এর বিগ অ্যাপল বোল, ফাইভ বেরি বোল, ও বারচার মুসলি বোল—এই তিনটির প্রত্যেকটিতেই ৩১ থেকে ৩৫ গ্রাম পর্যন্ত চিনি রয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি প্যাকেটে একটি পূর্ণ মার্স বারের চেয়ে বেশি চিনি। যদিও প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এগুলোতে ব্যবহৃত ফলমূলের কারণে চিনি ‘স্বাভাবিক’, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন—সেগুলোর অনেকটাই ফ্রি সুগার, যা স্বাস্থ্যবান্ধব নয়।
ফ্রি সুগার পুরোপুরি বাদ দেওয়া কি উচিত?
না। খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোপুরি চিনি বর্জন করার প্রয়োজন নেই। বরং কখন, কীভাবে খাচ্ছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। স্যাম রাইস বলছেন, “চিনির সঙ্গে প্রোটিন, ফ্যাট বা ফাইবার যুক্ত থাকলে রক্তে চিনি বাড়ার হার কমে যায়। যেমন চকোলেটের সঙ্গে কয়েকটা বাদাম খেলেই সুফল পাওয়া যাবে।”
জেসি ইনশাস্পে তার বই ‘গ্লুকোজ রেভোলিউশন’-এ লিখেছেন, খালি পেটে চিনি খেলে বিপদ বেশি, কিন্তু ভরা পেটে খেলে সেটা ধীরে শোষিত হয়।
শিশুদের চিনি খাওয়ার আগ্রহ কমাতে কী করবেন?
সরাসরি নিষেধ করলে শিশুদের মাঝে নিষিদ্ধ আকর্ষণ তৈরি হয়। বরং ছোট পরিমাণে, পরিমিতভাবে মিষ্টি খেতে দিন। পাশাপাশি তাদের স্বাদ পরিবর্তনের চেষ্টা করুন। প্রথমে ফ্লেভার্ড ইয়োগার্টের সঙ্গে সাধারণ ইয়োগার্ট মেশান, পরে শুধু প্লেইন ইয়োগার্টে ফল মেশান।
বাসায় তৈরি স্বাস্থ্যকর মিষ্টি সবচেয়ে ভালো। কলার রুটি বা বানানা ব্রেড বানিয়ে চিনি কমিয়ে দিন, সঙ্গে যোগ করুন বাদাম ও আটা। এতে করে খাওয়ার আনন্দ থাকবে, আবার ক্ষতির সম্ভাবনাও কমবে।
সবচেয়ে বড় কথা, ধীরে ধীরে কম চিনি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে শিশু ও বড়রা দু’জনেই মিষ্টি খাবার কম পছন্দ করতে শুরু করে। এবং সেটাই স্বাস্থ্য রক্ষার সবচেয়ে বড় কৌশল।










