কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: বছর শেষের কুয়াশাচ্ছন্ন মঙ্গলবার। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি শহরের আকাশটা আজ যেন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই ম্লান। সকালেই সীমান্ত পেরিয়ে খবর এল— বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আর নেই। এই খবর পৌঁছানো মাত্রই শোকের স্তব্ধতা নেমে এল শহরের নয়াবস্তি পাড়ায়। রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে এই শহর আজ তাঁর ‘ঘরের মেয়ে’কে হারানোর যন্ত্রণায় মুহ্যমান।
শৈশবের সেই ‘পুতুল’
১৯৪৫ সালে এই নয়াবস্তি পাড়াতেই জন্ম নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। পাড়ার মানুষের কাছে তিনি কোনো রাষ্ট্রনেতা নন, তিনি ছিলেন আদরের ‘পুতুল’। তাঁর শৈশবের দিনগুলো কেটেছে এই শহরের অলিগলিতে। তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল শহরের স্বনামধন্য ‘সুনীতিবালা সদর প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ।
আজ তাঁর প্রয়াণের খবরে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরূপ দে। তিনি বলেন: “ইতিহাসের পাতায় এই স্কুলের নাম তাঁর সঙ্গে চিরকাল জড়িয়ে থাকবে। আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর স্মরণে একটি বিশেষ সভার আয়োজন করব।”
শিকড়ের টান ও বিনিময় প্রথা
খালেদা জিয়ার বাবা মহম্মদ ইসকান্দর জলপাইগুড়ির নামী শেয়ার ও ব্যাঙ্কিং সংস্থা ‘দাশ অ্যান্ড কোম্পানি’তে কর্মরত ছিলেন। সম্পত্তি বিনিময় প্রথা মেনে তাঁরা ওপার বাংলায় চলে যান। যে ভিটেতে তাঁর শৈশব কেটেছে, সেখানে এখন বসবাস করে চক্রবর্তী পরিবার।
যদিও দেশভাগের পর খালেদা জিয়া নিজে আর জলপাইগুড়িতে ফিরতে পারেননি, কিন্তু তাঁর আত্মীয়রা নিয়মিত এই শহরে যাতায়াত করতেন। আজও প্রতিবেশী নীলাঞ্জন দাশগুপ্তদের কাছে তিনি এক জীবন্ত স্মৃতি।
এক প্রতিবেশী আক্ষেপের সুরে বললেন,”ওঁর আত্মীয়রা এলে এখনও আমার বাড়িতেই ওঠেন। আমাদের কাছে উনি সব সময় আমাদের পাড়ার সেই ছোট্ট পুতুল হয়েই থাকবেন। এ এক প্রতিবেশী বিচ্ছেদের বেদনা।”
রাজনীতি গৌণ, মুখ্য স্মৃতি
আজকের এই বিষণ্ণ সকালে জলপাইগুড়ি যেন ক্ষণিকের জন্য ফিরে গিয়েছিল দেশভাগের আগের সেই দিনগুলোতে। নয়াবস্তি পাড়ার বাতাসে এখন শুধুই স্মৃতিচারণ।
জন্মভিটের মানুষের কাছে আজ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বড় নয়, বড় হয়ে উঠেছে সেই পুতুলের স্মৃতি— যে মেয়েটি এই শহরের ধুলোবালি মেখে বড় হয়ে একদিন একটি রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধাতা হয়েছিলেন।
জলপাইগুড়ির ইতিহাস থেকে আজ একটি অধ্যায় চিরতরে মুছে গেল, কিন্তু রয়ে গেল হৃদয়ের টান।










