বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সকালে এখন এক নতুন সুর। আগ্রাবাদের কর্মব্যস্ত সড়ক থেকে শুরু করে খাতুনগঞ্জের মসলা আর পণ্যের সুবাসে ভরা অলিগলি, ইপিজেডের কলকারখানার চিরচেনা কোলাহল, কিংবা রিয়াজউদ্দিন বাজারের জমজমাট দোকানপাট। সবখানেই এখন এক অদৃশ্য উত্তেজনা বিরাজ করছে। মুখে নানা প্রতিশ্রুতি, চোখে সম্ভাবনার ঝিলিক। চেম্বার নির্বাচন যেন এক নিঃশব্দ উৎসবের আবাহন, যেখানে ব্যবসা আর রাজনীতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধনে জেগে উঠেছে বন্দরনগরী।
দীর্ঘ দেড় দশক পরে আবারও ফিরে আসছে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সরাসরি ভোটের নির্বাচন। শতবর্ষী এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিত, বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ কোন পথে পরিচালিত হবে—এমন নানা প্রশ্ন এখন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই নির্বাচন কেবল নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার লড়াই নয়, বরং বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের আগামী দিনের অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ব্যবসায়ীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, কারা আসবেন চেম্বারের হাল ধরতে। কোন প্যানেল বা কোন ব্যক্তি চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়েই চলছে জোর আলোচনা। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা সমীকরণ, যেখানে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেল, পুরোনো দিনের নেতৃত্ব আর নতুন দিনের ভাবনা—সবকিছুই এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক মহলে এখন একটাই প্রশ্ন: কে হবেন এই বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রের আগামী দিনের কাণ্ডারি?
খাতুনগঞ্জের এক পুরনো দোকানে বসে ৬০ বছরের ব্যবসায়ী আব্দুল করিম বলেন, “চেম্বার আমাদের শহরের হৃদস্পন্দন। এখানেই আমরা দিক পাই, আবার হারাইও। এবার মনে হচ্ছে, সত্যিকারের পরিবর্তনের সময় এসেছে।” তাঁর চোখে সেই বিশ্বাসের ছাপ, যা বহু বছর পর ব্যবসায়ী সমাজে জেগে উঠেছে।
ইউনাইটেড বিজনেস ফোরামের ব্যানারে মোহাম্মদ আমিরুল হক যখন মাঠে নেমেছেন, তখন অনেকেই তাঁকে দেখছেন অভিজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে—যিনি ব্যবসায়ীদের ঐক্য ও নীতি নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর প্রচারণার মূল বার্তা ‘বিজনেস ফার্স্ট’ যেন এক স্লোগান নয়, বরং এক দর্শন। চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ ইস্যুতে ব্যবসায়ীদের একত্রিত করতে তিনি যে নেতৃত্ব দেখিয়েছেন, তা ইতিমধ্যেই আলোচনার কেন্দ্রে।
অন্যদিকে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের নেতা এস এম নুরুল হক চাইছেন এক নতুন চেম্বার। তাঁর কণ্ঠে সংস্কারের অঙ্গীকার, পরিবর্তনের স্বপ্ন। তিনি বলছেন, “চেম্বার হতে হবে সকলের, কেবল কয়েকজনের নয়।”
সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় অফিস পর্যন্ত, সর্বত্র এখন ভোটের আলোচনা। দোকানমালিকেরা নিজের প্রার্থী নিয়ে তর্ক করেন, তরুণ উদ্যোক্তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালান, আর প্রার্থীরা প্রতিদিনই ব্যস্ত গণসংযোগে।
ইপিজেডের এক তরুণ উদ্যোক্তা রাব্বি হাসান বলেন, “আমরা এমন নেতৃত্ব চাই, যারা কাগজে নয়, বাস্তবে আমাদের পাশে থাকবে। এলসি, রপ্তানি, ট্যাক্স—সব জটিলতায় যেন আমাদের একটা নির্ভরতার ঠিকানা থাকে।”
চেম্বার ভবনের সামনে সন্ধ্যা নামে একটু ভিন্নভাবে। আলোর ঝলকানি, ব্যস্ত মুখ, আগ্রহভরা চোখ। যেন পুরো শহরই অপেক্ষা করছে ১ নভেম্বরের সকালটির জন্য—যেদিন ভোটবাক্স খুলে আসবে নতুন এক সূর্যের আলো। সেই আলোয় হয়তো চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা খুঁজে পাবেন তাঁদের নতুন পথপ্রদর্শক, নতুন বিশ্বাস।
চেম্বার নির্বাচন এখন আর কেবল নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নয়; এটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক প্রতীক—যেখানে ব্যবসার মানুষ খুঁজছেন স্বপ্নের দিশা, ভবিষ্যতের আশা, আর নিজের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি।