মূল রচনা: কাজী নজরুল ইসলাম
রূপান্তর ও নির্দেশনা: এ জে এম রবিউল আলম
মঞ্চায়ন স্থান: চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড (সিসিএল) অডিটরিয়াম
মঞ্চায়ন তারিখ: ০২ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার)
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা অবলম্বনে এবং বিশিষ্ট নাট্যকার এ জে এম রবিউল আলমের নির্দেশনায় চিটাগাং ক্লাবে প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হলো নাটক ‘জিনের বাদশা’। চিটাগাং ক্লাবের সদস্যদের নিজস্ব অভিনয়ে ও প্রযোজনায় দেড় ঘণ্টার এই নাটকটি দর্শকদের গ্রামীণ জনপদের হারানো ঐতিহ্য, প্রেম এবং তৎকালীন সামাজিক কুসংস্কারের এক অনবদ্য দলিলে নিয়ে গেছে।
নাট্য আখ্যান ও বিষয়বস্তু
নাটকের পটভূমি আবর্তিত হয়েছে গ্রামীণ সমাজের সহজ-সরল অথচ জটিল মনস্তত্ত্বকে ঘিরে। কেন্দ্রীয় চরিত্র ডানপিটে যুবক ‘আল্লারাখা’, যাকে গাঁয়ের মানুষ ডাকে ‘ইবলিশের পোলা’ বলে। পুঁথি পড়ে নিজেকে হানিফ গাজী আর তার প্রেমিকা চান ভানুকে সোনাভান কল্পনা করা আল্লারাখা চাষার ছেলে হয়েও নিজেকে ‘বাবু’ সাজাতে পছন্দ করে। চুলে কেশরঞ্জন তেল মেখে বাবরি দুলিয়ে সে যখন আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে আড্ডা দেয়, তখন দর্শকের মানসপটে ভেসে ওঠে আবহমান বাংলার এক রোমান্টিক যুবকের প্রতিচ্ছবি।
নাটকের গল্পে মোড় নেয় যখন আল্লারাখা চান ভানুর মন জয় করতে নানা ফন্দি ফিকির করে। চান ভানুর বিয়ে ভাঙতে সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের সুযোগ নিয়ে নিজেকে ‘জিনের বাদশা’ হিসেবে জাহির করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একদিকে সমাজের কঠোর বাস্তবতা, অন্যদিকে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে নাটকটি কমেডি থেকে ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। শেষ দৃশ্যে বাবরি চুল কেটে, বাবুগিরি ছেড়ে আল্লারাখার লাঙল কাঁধে ক্ষেতে যাওয়ার দৃশ্যটি এক হাহাকারের জন্ম দেয়, যা দর্শকদের অশ্রুসিক্ত করে।
নির্দেশনা ও অভিনয়
।নির্দেশক এ জে এম রবিউল আলম চিটাগাং ক্লাবে তাঁর ১৫তম নির্দেশনায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অপেশাদার অভিনয়শিল্পী (মূলত ক্লাব সদস্য ও তাদের পরিবার) নিয়ে তিনি যেভাবে গ্রামীণ আবহ এবং চরিত্রের গভীরতা ফুটিয়ে তুলেছেন, তা প্রশংসনীয়।
অভিনয়ে ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ফরহাত আব্বাস, প্রফেসর ডাঃ মুঃ বদিউল আলম, নাসরিন সরওয়ার মেঘলা, মন্জুরুল হক মন্জু, মোহাম্মদ শাহ একরাম, নাসরিন সরওয়ার মেঘলা, ফারিন মাহমুদ (টুশী),মো: মামুনুর রশীদ সাগর, ফাহমিদা জাফরীন, ফজলে ওয়ালি আহমেদ, শান্তা দাশ,এ্যাড.মো: জালাল উদ্দীন রাসেল,সীমান্ত বড়ুয়া এবং মান্না সরকার তাদের স্ব স্ব চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। বিশেষ করে আল্লারাখা ও চান ভানুর চরিত্রে বাচনভঙ্গি ও আবেগপ্রবণ দৃশ্যগুলো ছিল প্রাণবন্ত। প্রতিটি দৃশ্যের পর দর্শকদের করতালি প্রমাণ করে অভিনয়শিল্পীরা তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন
কারিগরি দিক
নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনায় মোস্তফা কামাল যাত্রা এবং আলোকসজ্জায় আসিফ ইবনে ইউসুফ (অনিক) সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড় কিংবা অশ্বথ গাছের তলা—মঞ্চে এই আবহ তৈরিতে তারা সফল ছিলেন। নাসরিন সরওয়ার মেঘলার পোশাক পরিকল্পনা এবং মঈনুদ্দিন কোয়েলের সঙ্গীত আবহ নাটকটির মেজাজ ধরে রাখতে সহায়তা করেছে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তুলতে শাহরিয়ার হান্নানের রূপসজ্জাও ছিল বিশ্বাসযোগ্য।
চিটাগাং ক্লাবের অডিটরিয়ামে উপচে পড়া ভিড় এবং দর্শকদের পিনপতন নীরবতা বলে দেয় ‘জিনের বাদশা’ একটি সফল প্রযোজনা। নাটকটিতে একদিকে যেমন হাস্যরস ছিল (আল্লারাখাকে ‘কেশরঞ্জন বাবু’ ডাকা), তেমনি ছিল সামাজিক অসঙ্গতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম বার্তা। সবশেষে প্রেম ও বিচ্ছেদের চিরন্তন হাহাকার নাটকটিকে একটি ধ্রুপদী উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ক্লাব কালচারের মধ্যে এমন সাহিত্যনির্ভর ও রুচিশীল নাটকের মঞ্চায়ন নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।










