Home সারাদেশ ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা জীবনের চলচিত্র

ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা জীবনের চলচিত্র

ফিচার

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চলন্ত ট্রেনের জানালায় চোখ রাখলেই এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা আসে। তীব্র গতিতে পেছনে ছুটে চলা গাছপালা, মাঠ, পুকুর, গ্রাম্য রাস্তা, মানুষের চলাফেরাসব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত চলচ্চিত্র। এই দৃশ্যপট শুধু নয়নের আরাম নয়, বরং এক একটি ফ্রেম হয়ে ওঠে সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রকৃতি ও সময়ের মিলিত কাহিনি। আমরা যারা ট্রেনে করে চলাফেরা করি, তাদের কাছে এ দৃশ্য একদিকে নস্টালজিক, অন্যদিকে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি।

ভোরের ট্রেন যখন গ্রামাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলে, তখন জানালার বাইরের আলো আর বাতাসে ভেসে আসে অন্যরকম ঘ্রাণ। দূরে দেখা যায় বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া পাকা রাস্তার পাশ ঘেঁষে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে আছে কলা গাছ। একেকটা গাছ যেন খাড়া হয়ে আছে শৃঙ্খলা আর সুনিপুণ যত্নের নিদর্শন হয়ে। তাদের পাতার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ে মাঠের ওপর, আর সেখানেই গাঁয়ের কৃষকেরা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনছে সোনালী ফসল। আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে বাতাসের নৃত্য চলে সেই দোলা যেন চাষির চোখেমুখে এনে দেয় নতুন দিনের সাহস।

ট্রেন ছুটে চলে আরো সামনের দিকে। পাশের গ্রামে তখন ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। স্কুলগামী শিশুরা মা-বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে, সাইকেলচালিত ভ্যান রোদ ও ধুলো পেরিয়ে যাচ্ছে পাশের হাটে। গরুর গাড়িতে করে আনা হচ্ছে লাউ, কুমড়া, ধান বা কলার কাঁদি। রেলপথের দুপাশে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর, টিনের চাল, মাটির উঠোন সবই যেন মানুষের সাধনা ও টিকে থাকার গল্প বলে যায়। কেউ কাপড় শুকাচ্ছে, কেউ চুলায় হাঁড়ি চাপাচ্ছে, কেউবা গরু নিয়ে হালচাষে নামছে এই বহমান চিত্রই গ্রামবাংলার বাস্তব অবস্থা।

চোখ আটকে যায় খেজুর গাছের সারিতে। মাথা উঁচিয়ে তারা দাঁড়িয়ে থাকে শতাব্দীর প্রহরীর মতো। শীতের সকালে এসব গাছে বসানো হয় রসের হাঁড়ি। সেই রস দিয়ে তৈরি হয় পাটালি, গুড় যা শুধু খাদ্য নয়, একপ্রকার ঐতিহ্য। এ গাছের ছায়া পড়ে জমিতে, আর তার নিচে শিশু-কিশোরেরা খেলায় মেতে ওঠে।

হঠাৎ ট্রেন চলে আসে এক কারখানার পাশ দিয়ে। ধোঁয়ায় আকাশ কিছুটা মলিন, তবে সেই ধোঁয়া ভেদ করেও দেখা যায় লোহার কাঠামো, বালতির মতো মুখ খোলা বিশাল চিমনি আর শ্রমিকদের ব্যস্ততা। এই কলকারখানাগুলো কোনো শহরের মধ্যে নয়, বরং গ্রামের এক কোণে গজিয়ে ওঠা এক নতুন বাস্তবতা। এখানকার শ্রমিকেরা দিন শুরু করে সূর্য ওঠার আগে, আবার ফেরে সন্ধ্যার অন্ধকারে। তাদের মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে জীবনধারণের দায়। তারা অনেকেই আশপাশের গ্রাম থেকে আসে হাঁটা পথ, সাইকেল, এমনকি ট্রেন ধরেও।

রেললাইনের ধারে ধারে নানা চিত্র দেখা যায়। কোথাও শিশুরা কঞ্চির সঙ্গে ছাগল বেঁধে রাখছে, কোথাও নারীরা বাঁশ কেটে রোদে শুকোতে দিচ্ছে, আবার কোথাও বুড়ো চাচা নাতিকে গল্প শোনাচ্ছে। এতসব দৃশ্য একসঙ্গে দেখার সুযোগ শহরের মানুষ পায় না, কিন্তু ট্রেনযাত্রীরা পায়। সেই কারণেই ট্রেন যেন শুধু যাতায়াতের বাহন নয়, বরং একটি ভ্রাম্যমাণ দর্শনমঞ্চ যেখানে জীবনের প্রতিটি অধ্যায় উঠে আসে একেকটি দৃশ্যের মাধ্যমে।

চলন্ত ট্রেনের জানালায় এভাবেই ধরা পড়ে সময়ের প্রেক্ষাপটে গ্রামবাংলার এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। সারি সারি কলা গাছ, ঝিরঝিরে খেজুর পাতার দোলা, আখক্ষেতের সবুজ আচ্ছাদন, শ্রমজীবী মানুষের মুখচ্ছবি, শিশুদের প্রাণবন্ত হাঁটাহাঁটি, পেছনে পড়ে যাওয়া পুকুরঘাট, কিংবা রেলগাড়ির শব্দে জেগে ওঠা এক ঘুমন্ত গ্রাম সবই একসঙ্গে গাঁথা থাকে হৃদয়ের ফ্রেমে।

এইসব চিত্র যে শুধু দেখার নয়, তা ভাবনারও। আমাদের মাটি, মানুষ, সংস্কৃতি, শ্রম আর ভালোবাসার এক মিলিত প্রকাশ এ দৃশ্যপট। যেকোনো ট্রেনযাত্রী একটু মনোযোগ দিলে টের পায়, চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে জীবনের যে খণ্ডচিত্র সে দেখছে, তা কেবল দেশপ্রেম নয় এ এক অবিরাম সময়চিহ্ন, যেটা যুগে যুগে মানুষের আত্মপরিচয় রচনা করে যায়।