বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, বাকৃবি ( ময়মনসিংহ): পকেটে টাকা থাকলে একটি ডেইরি ফার্ম বা খামার শুরু করা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু সেই ফার্মটি টিকিয়ে রাখা এবং লাভজনক করে তোলাই মূল চ্যালেঞ্জ। খামার শুরু করার আগে ও পরে এমন কিছু বিষয় বিবেচনা করা দরকার, যা ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যেমন—ফার্মের জায়গা নির্বাচন, ভেটেরিনারি ডাক্তারের সহজলভ্যতা, গরুর খাবারের উৎস, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উৎপাদিত দুধ বিক্রির বাজার ব্যবস্থা।
অনেকেই শখ থেকে বা বাড়তি আয়ের আশায় ডেইরি ফার্ম করতে চান। তাদের মনে প্রশ্ন থাকে—কেমন সেটআপ প্রয়োজন? কয়টি গরু দিয়ে শুরু করলে লোকসানের ঝুঁকি কম? বিশেষ করে যারা সীমিত বাজেটে ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসেবে ছোট পরিসরে শুরু করতে চান, তাদের জন্যই আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন ও নির্দেশিকা।
পরিকল্পনা ও প্রাথমিক প্রস্তুতি
যাদের বাজেট সীমিত কিন্তু ইচ্ছা প্রবল, তাদের জন্য একটি আদর্শ মডেল হতে পারে ৩,৮০,০০০ (তিন লক্ষ আশি হাজার) টাকার প্রজেক্ট। পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে কমপক্ষে ১৫ লিটার দুধ দিতে সক্ষম (বাছুরসহ) ২টি গরু দিয়ে যাত্রা শুরু করার ভিত্তিতে।
অবকাঠামো:
গোয়াল ঘর: ৩০ ফুট বাই ১৫ ফুট।
সুযোগ-সুবিধা: পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা।
হিসাব-নিকাশ: এককালীন খরচ
ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক মূলধন বা এককালীন খরচগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. গরু ক্রয়: ২ টি উন্নত জাতের দুধের গরু (দাম আনুমানিক) = ৩,০০,০০০/- টাকা।
২. গোয়াল ঘর নির্মাণ: (টিনশেড বা সাধারণ কাঠামো) = ৬০,০০০/- টাকা।
৩. ইলেক্ট্রিক ও পানির পাম্প: ২০,০০০/- টাকা।
সর্বমোট প্রাথমিক বিনিয়োগ: ৩,৮০,০০০/- টাকা।
মাসিক আয়-ব্যয়ের খতিয়ান
ফার্ম তো হলো, এবার দেখা যাক প্রতিদিনের আয় এবং ব্যয়ের চিত্রটি কেমন।
সম্ভাব্য আয়:
এখানে বাস্তবসম্মত হিসাব ধরা হয়েছে। যদিও গরুর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা ১৫ লিটার, কিন্তু বছরের ৮ মাস বা পুরো সময় একই পরিমাণ দুধ পাওয়া যায় না। তাই গড়পড়তা বাছুর ও গরুর স্বাস্থ্য বিবেচনায় প্রতিদিন গড়ে ২০ লিটার (দুই গরু মিলে) দুধ ধরা হয়েছে।
দৈনিক বিক্রি: ২০ লিটার x ৫০ টাকা (গড় বাজার দর) = ১,০০০ টাকা।
মাসিক মোট আয়: ১,০০০ x ৩০ দিন = ৩০,০০০ টাকা।
মাসিক ব্যয়:
কর্মচারীর বেতন (পার্ট টাইম বা নিজের শ্রমের মূল্য): ৭,০০০ টাকা।
গরুর খাবার খরচ: (প্রতি গরু ১৫০ টাকা x ২) = ৩০০ টাকা/দিন। মাসে ৯,০০০ টাকা।
ঔষধ ও অন্যান্য খরচ: ২,০০০ টাকা।
মাসিক মোট ব্যয়: ১৮,০০০ টাকা।
লাভ ও মূলধন ফেরত আসার সময়
মাসিক নিট লাভ: (৩০,০০০ – ১৮,০০০) = ১২,০০০ টাকা।
এই হিসাব অনুযায়ী, আপনার প্রাথমিক বিনিয়োগের ৩,৮০,০০০ টাকা উঠে আসতে সময় লাগবে প্রায় ৩১ মাস বা ২ বছর ৭ মাস। অনেকের কাছে সময়টা দীর্ঘ মনে হতে পারে, কিন্তু এখানেই রয়েছে কৌশলের খেলা।
দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ও সম্পদের হিসাব
শুধু মাসিক ১২ হাজার টাকা লাভ দেখলেই চলবে না। এই ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে এবং লাভ বাড়াতে একটি কৌশল অবলম্বন করতে হবে:
কৌশল: প্রথম গরু কেনার ৮ মাস পর লভ্যাংশ বা জমানো টাকা দিয়ে আরও ২টি দুধের গরু কেনার চেষ্টা করতে হবে অথবা ধাপে ধাপে আগাতে হবে। এতে আপনি একটি ‘সার্কেল’ বা চক্রের মধ্যে প্রবেশ করবেন। ফলে, যখন প্রথম গরুগুলোর দুধ কমে যাবে, তখন নতুন গরুগুলো থেকে আয় আসবে। এতে পকেট থেকে কখনোই গরুর খাবার বা কর্মচারীর বেতন দিতে হবে না।
২.৫ বছর পর আপনার অবস্থান:
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আড়াই বছর পর আপনার ব্যালেন্স শিট বা সম্পদের পরিমাণ।
১. আপনার প্রাথমিক বিনিয়োগ উঠে এসেছে।
২. আপনার গোয়ালে এখন গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে (বাছুর বড় হয়েছে)।
৩. গরুর বর্তমান বাজার মূল্য যোগ করলে দেখবেন আপনার সম্পদের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়েছে।
যারা ডেইরি ব্যবসায় আসতে চান, তাদের প্রতি অনুরোধ—শুধু নগদ টাকার দিকে না তাকিয়ে, সম্পদের (Asset) পরিমাণ কীভাবে বাড়ছে তা হিসাব করুন। সঠিক পরিকল্পনা আর ধৈর্য থাকলে ডেইরি ফার্ম অবশ্যই একটি লাভজনক এবং সম্মানজনক পেশা হতে পারে।
আপনার মতামত জানান:
উপরের হিসাব অনুযায়ী ২.৫ বছর পর আপনার মোট সম্পদের পরিমাণ কত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আপনার ধারণা বা হিসাব কমেন্ট করে আমাদের জানান। এতে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন।










