বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুমিল্লা: মাত্র ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে কক্সবাজারের টেকনাফের একটি মাদক মামলার প্রকৃত আসামির পরিবর্তে নকল আসামি (প্রক্সি) হিসেবে জেল খাটছেন নুর মোহাম্মদ (৩৩)। আদালত থেকে কারাগারে পাঠানোর পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট (আঙ্গুলের ছাপ) যাচাই করতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়লে কুমিল্লা আদালত ও কারাগারে তোলপাড় শুরু হয়।
প্রকৃত আসামি জোবাইদ পুতিয়া (৩৫) টেকনাফ উপজেলার নাইট্যমপাড়া গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে। আর প্রক্সি আসামি নুর মোহাম্মদ টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফকির আহাম্মদের ছেলে।
কারা সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার একটি মাদক মামলায় জোবাইদ পুতিয়া কারাগারে যান এবং ২০১২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করেন। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে থাকেন। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে মামলা স্থানান্তর হয় কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে।
চলতি বছরের ১২ আগস্ট ঐ আদালতে জোবাইদ পুতিয়া পরিচয় দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন এক ব্যক্তি। আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশের সময় আঙ্গুলের ছাপ যাচাই করে জানা যায়, আসল আসামির বদলে নুর মোহাম্মদ নামের আরেকজনকে কারাবন্দি করা হয়েছে। আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জোবাইদ পুতিয়ার কাছ থেকে নুর মোহাম্মদ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন প্রক্সি আসামি হিসেবে জেল খাটতে। তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে জামিনে মুক্ত করা হবে।
নুর মোহাম্মদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এএইচএম আবাদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমি আসামিকে নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে নিজেকে জোবাইদ পুতিয়া বলে পরিচয় দেয়। এনআইডি কার্ড চাইলে সে জানায়, বিদেশ থেকে এসেছে এবং কার্ড পরে দেবে। আমি এর আগে তাকে কখনো দেখিনি। পরে ঘটনা জানার পর আমি নিজেই হতবাক। আমার ক্যারিয়ারে এমন ঘটনা হয়নি।”
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খন্দকার মিজানুর রহমান বলেন, “আসামি নিয়ে এমন ঘটনা চলতে থাকলে অপরাধের মাত্রা বাড়বে। আসল আসামিকে ধরতে হবে এবং এনআইডি যাচাই বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেলা সুপার হালিমা আক্তার বলেন, “আদালত থেকে আসা সব আসামির ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়। এতে প্রকৃত পরিচয় ধরা পড়ে। ১৪ আগস্ট আমরা বিষয়টি লিখিতভাবে আদালতকে জানিয়েছি। এখন আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বর্তমানে নকল আসামি নুর মোহাম্মদ কারাগারে আছেন। আর প্রকৃত আসামি জোবাইদ পুতিয়াকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে।
পুরোনো নজির: প্রক্সি আসামির কাহিনি নতুন নয়
বাংলাদেশে এর আগে বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলায় প্রকৃত আসামির বদলে প্রক্সি আসামিকে হাজির করার ঘটনা সামনে এসেছে।
- নারায়ণগঞ্জের একটি হত্যা মামলায় দেখা যায়, মূল আসামির পরিবর্তে হাজির হন তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। পরে আঙ্গুলের ছাপ মেলাতে গিয়ে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
- চট্টগ্রামে একটি মাদক মামলায় মূল আসামির পরিবর্তে একই এলাকার দিনমজুরকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। বিনিময়ে তাকে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু জেল থেকে বের হতে না পারায় ঘটনা ফাঁস হয়।
- রাজশাহীতে অস্ত্র মামলার এক আসামির বদলে ভিন্ন একজন হাজির হয়ে জেল খাটেন প্রায় দুই মাস। পরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের সময় ধরা পড়ে সত্য।
এই ঘটনাগুলো একদিকে যেমন আদালত ও কারাগার ব্যবস্থাপনায় নজরদারির অভাবকে নির্দেশ করে, অন্যদিকে দালালচক্রের সক্রিয় ভূমিকাও স্পষ্ট করে।
কেন ঘটছে এমন অপরাধ?
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত আসামিরা রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক সামর্থ্য কিংবা প্রশাসনিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রক্সি আসামি ব্যবহার করে থাকেন। এর পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে—
- আদালতের ব্যস্ততা ও চাপ: প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়। ফলে যাচাই-বাছাইয়ে ঘাটতি থাকে।
- দালালচক্রের সক্রিয়তা: আদালত প্রাঙ্গণে সক্রিয় দালালচক্র এ ধরনের প্রক্সি আসামি সরবরাহ করে থাকে।
- আইডি যাচাইয়ের ঘাটতি: আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা বায়োমেট্রিক যাচাই বাধ্যতামূলক নয়।
- দুর্নীতির সুযোগ: নিম্নপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষের বিনিময়ে এসব অনিয়মে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।