বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুমিল্লা: কুমিল্লার বরুড়ার দিনমজুর নজির আহমেদ (৪০)। করাতকলের শ্রমিক তিনি, দৈনিক মজুরি মাত্র ৭০০ টাকা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। হঠাৎ দুর্ঘটনায় কবজি থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তার সংসার, সন্তানদের ভবিষ্যৎ—সবকিছুই যেন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের দ্রুত পদক্ষেপ ও দক্ষতায় সেই হাত ফেরত পেলেন নজির। এই সফলতা শুধু একজন শ্রমিককে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর নয়, বরং বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সক্ষমতারও প্রতীক।
দুর্ঘটনার মুহূর্ত ও চিকিৎসকদের সংগ্রাম
২ সেপ্টেম্বর আদমসার গ্রামে ট্রাক থেকে গাছের গুঁড়ি নামানোর সময় হঠাৎ নজিরের হাত চাপা পড়ে যায়। সহকর্মীরা বিচ্ছিন্ন হাতটি পলিথিনে ভরে হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রথমে ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় কুমিল্লা ট্রমা সেন্টারে। সেখানেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচারে হাত পুনঃসংযোজন করা হয়।
অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন ময়নামতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, সময়মতো রোগীকে আনা না হলে সফলতা আসা সম্ভব হতো না। বর্তমানে নজিরের হাত সাড়া দিচ্ছে, যা চিকিৎসকদের কাছে এক বড় আশার খবর।
শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের শ্রমিকরা প্রতিদিনই নানা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন। করাতকল, ইটভাটা, নির্মাণশিল্প কিংবা গার্মেন্টস—সবখানেই নিরাপত্তার অভাব প্রকট। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজারো শ্রমিক অঙ্গহানি কিংবা প্রাণহানির শিকার হন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনা ঘটলে চিকিৎসার খরচ বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। নজিরের ক্ষেত্রেও চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল প্রবল। তবে হাসপাতাল প্রশাসন তাকে আশ্বস্ত করে প্রথমে চিকিৎসা, পরে খরচের ব্যবস্থা করার কথা জানায়।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
বিশ্বে অঙ্গ পুনঃসংযোজনের চিকিৎসা বহুদিন ধরেই চালু। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি বা জাপানের মতো দেশে মাইক্রোসার্জারির সফলতার হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। ভারতে তো শিশুসহ বহু রোগীর হাত-পা পুনঃসংযোজনের খবর আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো এই চিকিৎসা সীমিত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজধানীমুখী। তবে কুমিল্লায় নজিরের সফল অস্ত্রোপচার প্রমাণ করল—রাজধানীর বাইরে জেলায়ও যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পর্যাপ্ত অবকাঠামো থাকে, তবে জটিল চিকিৎসা সফল করা সম্ভব।
চিকিৎসা অবকাঠামো ও ভবিষ্যৎ করণীয়
বাংলাদেশে প্লাস্টিক ও রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি বিভাগ এখনো জনবল সংকটে ভুগছে। দুর্ঘটনায় অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হলে বেশিরভাগ মানুষই জানেন না কীভাবে সেটি সংরক্ষণ করে হাসপাতালে নিতে হয়। অথচ আন্তর্জাতিক গাইডলাইন বলছে, অঙ্গটি পরিষ্কার কাপড় বা পলিথিনে ভরে বরফসহ ঠাণ্ডা পরিবেশে রাখলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে পুনঃসংযোজন সম্ভব হয়। সচেতনতা বাড়ানো, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে মাইক্রোসার্জারি সুবিধা বাড়ানো এখন জরুরি প্রয়োজন।
নজিরের গল্প: একটি প্রতীক
নজির আহমেদের দুর্ঘটনা একদিকে শ্রমিক জীবনের ঝুঁকিকে সামনে নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে চিকিৎসকদের সাফল্যে ভরসা জুগিয়েছে। দিনমজুর হয়েও তিনি আবার হাতে স্পর্শের অনুভূতি পাচ্ছেন—এ যেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের মানবিক সেবার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত আজ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও যে সাফল্যের গল্প লিখছে, নজিরের ফেরত পাওয়া হাত তারই প্রমাণ। তবে এ গল্প একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয়—শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও চিকিৎসা অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া আরও কত নজির হয়তো তাদের হাত বা জীবন হারাবে।