Home অন্যান্য ‘গভর্নমেন্ট কা মাল দরিয়া মে ঢাল’

‘গভর্নমেন্ট কা মাল দরিয়া মে ঢাল’

ছবি: এ আই

জীবনের রিপোর্টার

স্রেফ একটি রিপোর্ট নাকি পুকুর চুরির দালিলিক ‘বৈধতা’?

কামরুল ইসলাম

তখন চুরাশি সালের শেষদিক। এরশাদ আমল। আজকের মতো ডিজিটাল মিডিয়ার জৌলুস নেই, কিন্তু খবরের কাগজে ছাপা হওয়া একেকটি শব্দের ওজন ছিল পরমাণু বোমার মতো। আমি তখন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রামে। রাজধানীতে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকার দাপট, তার মধ্যে ‘সংবাদ’ অন্যতম। চট্টগ্রামে তখন আমাদের নিজস্ব কোনো অফিস নেই; আগ্রাবাদে তাহের চেম্বারে সম্পাদক ও মালিক আহমদুল কবির সাহেবের বাণিজ্যিক অফিসেই আমার সাংবাদিকতার ডেরা।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ। মুক্তবাজার অর্থনীতির জোয়ার তখনো লাগেনি। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য একচেটিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণে। ইটভাটার জ্বালাণি থেকে শুরু করে কলকারখানা, সবখানেই কয়লার কদর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘কয়লা পরিদপ্তর’ বিদেশ থেকে এই কালো হীরা আমদানি করত। ঢাকার মতিঝিল মোড় আর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সরকারি কার্যভবনে ছিল তাদের অফিস।

বিশাল সব মাদার ভেসেল বিদেশি কয়লা নিয়ে এসে ভিড়ত কুতুবদিয়ার অদূরে গভীর সমুদ্রে। সেখান থেকে লাইটারেজ জাহাজে করে সেই কয়লা আনা হতো পতেঙ্গায়, কর্ণফুলীর তীরে। আজকের যে চকচকে বোট ক্লাব তার অদূরেই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েই ছিল কয়লার রাজত্ব। আজও লোকমুখে এলাকাটি ‘কয়লার ডিপো’ নামেই পরিচিত, এমনকি ওখানকার পুলিশ ফাঁড়িটির নামও ‘কয়লার ডিপো ফাঁড়ি’।

কিন্তু সমস্যা ছিল ব্যবস্থাপনায়। খোলা আকাশের নিচে, একেবারে নদীর বুক ঘেঁষে ডাম্পিং করা হতো হাজার হাজার টন কয়লা। সুরক্ষার জন্য কোনো বাউন্ডারি ওয়াল বা ঘেরাবেড়া, কিছুই ছিল না।

একদিন আগ্রাবাদ অফিসে ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে কয়লা পরিদপ্তরের এক সহকারী পরিচালক। বেশ উদ্বেগ নিয়ে বললেন, “ভাই, একটা বড়সড় অনিয়ম হচ্ছে। পতেঙ্গায় আমাদের কয়লাগুলো একেবারে নদীর পাড় ঘেঁষে রাখা। আমি বারবার উপরমহলকে বলছি একটা দেয়াল দিতে, কেউ কানে তুলছে না। ভরা জোয়ার শেষে ভাটার টানে বিপুল পরিমাণে কয়লা নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। আপনারা কিছু না লিখলে এই সরকারি সম্পদ রক্ষা পাবে না।”

সোর্স যখন স্বয়ং দপ্তরের কর্মকর্তা, তখন সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। ছুটে গেলাম পতেঙ্গায়। গিয়ে দেখি এলাহী কাণ্ড! কালো পাহাড়ের মতো কয়লার স্তূপ, আর তার গা ঘেঁষে কর্ণফুলীর উত্তাল জলরাশি। নিজের চোখেই দেখলাম, জোয়ারের পানি নামার সময় কয়লা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সুযোগে একদল স্থানীয় লোক ছোট ছোট ডিঙি নৌকা আর সাম্পান নিয়ে ওঁত পেতে আছে। রশির মাথায় বালতি বেঁধে তারা নদী থেকে সেই ‘পরিত্যক্ত’ কয়লা তুলছে। পাড়ে তুলে সেই ভেজা কয়লা চলে যাচ্ছে চায়ের দোকানে, গৃহস্থালির রান্নায়।

কর্মকর্তা আমাকে একটা আনুমানিক হিসাবও দিলেন, প্রতিদিন কত টন কয়লা এভাবে ‘মিসিং’ হচ্ছে। আমি আর দেরি করলাম না। ছবি তুললাম, তথ্য সাজালাম। ‘সংবাদ’-এ বেশ ফলাও করে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হলো। শিরোনাম ছিল হিন্দি প্রবাদটি- ‘গভর্নমেন্ট কা মাল দরিয়া মে ঢাল’

রিপোর্টের ইমপ্যাক্ট হলো জাদুর মতো। টনক নড়ল কর্তৃপক্ষের। দ্রুত বরাদ্দ পাস হলো, নদীর তীর ঘেঁষে বিশাল বাউন্ডারি ওয়াল উঠল। কয়লা আর নদীতে ভেসে যায় না। আমার তখন বুকভরা গর্ব। সাংবাদিক হিসেবে এর চেয়ে বড় সার্থকতা আর কী হতে পারে? সরকারি সম্পদ রক্ষা পেল!

কয়লা পরিদপ্তরের ওই কর্মকর্তাদের সাথে আমার তখন বেশ খাতির। চা-পানি খাওয়া হয়, কুশল বিনিময় হয়। কিছুদিন পর সেই সহকারী পরিচালক আবার ফোন দিলেন। এবার কণ্ঠে আরও উদ্বেগ। বললেন, “ভাই, আপনার রিপোর্টে তো বাউন্ডারি হলো, ভেসে যাওয়া বন্ধ হল। কিন্তু এখন আরেক বিপদ। কয়লা তো দাহ্য পদার্থ। দীর্ঘদিন খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখায় ভেতরে ‘ইন্টারনাল কমবাসন’ (স্বতঃস্ফূর্ত দহন) হচ্ছে। নিজের গরমে নিজেই জ্বলে যাচ্ছে কয়লা। প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে।”

আবারও স্পটে গেলাম। দেখি সত্যিই তো! বিশাল স্তূপের এখান-ওখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, কোথাও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিস বা পানি দিয়ে একদিকের আগুন নেভানো হলে অন্যদিকে জ্বলে উঠছে। ছবি কথা বলে। দাউ দাউ আগুনের ছবিসহ আবারও রিপোর্ট করলাম। আবারও বাহবা পেলাম।

এখানেই গল্পের ‘দৃশ্যমান’ অংশের শেষ হতে পারত। আমি একজন সফল রিপোর্টার, যে সরেজমিনে তদন্ত করে সত্য তুলে এনেছে। কোনো সন্দেহ নেই, চোখের দেখা কি আর ভুল হতে পারে?

কিন্তু গল্পের আসল টুইস্ট বা ‘নেপথ্য কারণ’ জানতে পারলাম অনেক বছর পর। ততদিনে কয়লা পরিদপ্তর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই কর্মকর্তাদের কেউ অবসরে, কেউ বা পরপারে। একদিন পুরোনো এক সূত্রের মাধ্যমে জানলাম সেই ‘ইন্টারনাল স্টোরি’, যা শুনে আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার জোগাড়।

পুরো ঘটনাটি ছিল এক বিশাল ‘পুকুর চুরি’র নিখুঁত ছক।

কর্মকর্তারা জানতেন, ডিপোতে যে পরিমাণ কয়লা থাকার কথা, তার চেয়ে হাজার হাজার টন কয়লা কম আছে। কারণ? সিন্ডিকেট করে সেই কয়লা আগেই চোরাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। অডিট বা হিসাবের সময় এই ঘাটতি ধরা পড়লে সবার চাকরি যাবে, জেল হবে। তাই প্রয়োজন ছিল একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত’।

আর সেই অজুহাত তৈরির তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল আমাকে—একজন অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিককে।

আমার প্রথম রিপোর্টটি দিয়ে তারা দালিলিক প্রমাণ তৈরি করল যে, “প্রচুর কয়লা নদীতে ভেসে গেছে।” দ্বিতীয় রিপোর্টটি দিয়ে প্রমাণ করল, “অনেক কয়লা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”

আমার তোলা ছবি, আমার লেখা রিপোর্ট এগুলোই ছিল তাদের অডিট আপত্তির জবাব। তারা সম্ভবত ফাইলে আমার কাটিং লাগিয়ে লিখে দিয়েছিল— “দেখুন, দেশের জাতীয় দৈনিকেই ছবিসহ রিপোর্ট এসেছে, প্রাকৃতিক কারণে কীভাবে কয়লা নষ্ট হয়েছে।”

নদীতে যা ভেসেছিল কিংবা আগুনে যা পুড়েছিল, তা ছিল চোরাপথে পাচার হয়ে যাওয়া কয়লার তুলনায় নগণ্য। কিন্তু আমার রিপোর্ট সেই ‘নগণ্য’ ক্ষতিকে ‘বিশাল’ হিসেবে দেখানোর লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আমি দেশের সম্পদ বাঁচাচ্ছি, অথচ আমি অজান্তেই চোরদের চুরির ‘ইনডেমনিটি’ বা বৈধতা দিয়ে দিয়েছি।

একালের রিপোর্টারদের জন্য শিক্ষা:
সাংবাদিকতায় ‘সরেজমিন’ তদন্ত সবচেয়ে জরুরি, এটা সত্য। কিন্তু চোখের দেখাই সব সময় চূড়ান্ত সত্য নয়। কেউ যখন নিজে থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে আপনাকে কোনো দুর্নীতির খবর দেয়, তখন দ্বিতীয়বার ভাবুন—কেন দিচ্ছে? তার স্বার্থটা কী?

১. মোটিভ খুঁজুন: সোর্স যখন ‘ভেতরের লোক’ হয়, তখন তার উদ্দেশ্য সব সময় মহৎ নাও হতে পারে। সে কি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়? নাকি নিজের কোনো বড় অপরাধ ঢাকতে ছোট কোনো অপরাধের খবর আপনাকে দিয়ে ‘লিক’ করাচ্ছে?
২. হিসাব মেলান: যা দেখছেন, তার সাথে পরিসংখ্যানের বা লজিকের মিল আছে তো? যেমন—নদীতে কয়লা ভাসছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কি হাজার হাজার টনের ঘাটতি হওয়া সম্ভব?
৩. শাঁখের করাত: মনে রাখবেন, চতুর দুর্নীতিবাজরা সাংবাদিকদের ব্যবহার করতে ওস্তাদ। তারা আপনাকে এমন নিখুঁতভাবে ‘ফিড’ করবে যে আপনি বুঝতেই পারবেন না, আপনি তাদের দাবার ঘুঁটি হয়ে গেছেন।

সেদিন আমার রিপোর্ট দুটি জাস্টিফাইড ছিল, ছবিগুলোও সত্য ছিল। কিন্তু কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট ছিল সাজানো। সাংবাদিকতার জীবনে এই আক্ষেপ আমার আজও আছে। আমি রিপোর্ট করেছি, কিন্তু রিপোর্টের পেছনের রিপোর্টটা তখন করতে পারিনি।