আজহার মুনিম, লন্ডন: লন্ডনে নিষিদ্ধ সংগঠন প্যালেস্টাইন অ্যাকশন-এর সমর্থনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে শনিবার প্রায় পাঁচ শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। ম্যানচেস্টারের একটি সিনাগগে সন্ত্রাসী হামলার পর ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পুলিশ ও দাতব্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ স্থগিতের আহ্বান সত্ত্বেও সংগঠনটির অনুসারীরা লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে ব্যাপক বিক্ষোভ করে।
শনিবার দুপুর থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ার, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ ও ডাউনিং স্ট্রিট এলাকায় হাজারো মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল “I oppose genocide, I support Palestine Action” লেখা ব্যানার ও ফিলিস্তিনের পতাকা। অনেকেই স্লোগান দেন—“From the river to the sea, Palestine will be free” এবং “Long live the Intifada।”
পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত মোট ৪৯২ জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৪৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে “নিষিদ্ধ সংগঠনকে সমর্থনের অভিযোগে”, বাকিরা মদ্যপ অবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, হামলা বা পূর্বের মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ১৮ এবং প্রবীণতম ৮৯ বছর বয়সী।
ম্যানচেস্টারেও “গ্রেটার ম্যানচেস্টার ফ্রেন্ডস অব প্যালেস্টাইন” নামে একটি সংগঠন শহরের ক্যাথেড্রালের সামনে সমাবেশ ও মিছিল করে। বক্তারা সেখানে “Zionism is the disease, resistance is the cure” বলে শ্লোগান দেন এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র বিলুপ্তির আহ্বান জানান।
সংঘর্ষ ও গ্রেপ্তার
লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাল্টা বিক্ষোভকারীরা “God bless the IDF” ও “F— Hamas” বলে চিৎকার করলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। একজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয় যিনি ডেভিডের তারা–এর ভেতরে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হুডি পরে ছিলেন। এছাড়া, এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয় যিনি হামাসকে “স্বাধীনতার যোদ্ধা” হিসেবে উল্লেখ করেন।
৭৯ বছর বয়সী এলিজাবেথ মরলি, যিনি হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা এক নারীর কন্যা, তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতিবাদে অংশ নেওয়া অন্ধ এক ব্যক্তি মাইক হিগিনস বলেন, “আমাদের বলা হচ্ছে আমরা সন্ত্রাসী, কিন্তু আমরা শুধু কথা বলার অধিকার চাই।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বিক্ষোভ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা স্যার কিয়ার স্টার্মার বিক্ষোভ স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “ইহুদি সম্প্রদায়ের শোককে সম্মান করা জরুরি।”
অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী শাবানা মাহমুদ অনুরোধ করেন, “কমপক্ষে কয়েক দিনের জন্য হলেও বিরতি দিন, যাতে শোকাহত ইহুদি জনগণ কিছুটা সময় পায়।”
সাবেক লেবার এমপি ও চরমপন্থা বিরোধী উপদেষ্টা লর্ড ওয়ালনি বলেন, “এই বিক্ষোভ শুধু শোকাহত ইহুদিদের প্রতি নির্মম অবজ্ঞাই নয়, বরং প্যালেস্টাইন আন্দোলনের জন্যও কৌশলগত বিপর্যয়।”
লেবার এমপি লুক একহার্স্ট মন্তব্য করেন, “প্রতিবাদের অধিকার অবশ্যই আছে, তবে এমন সময়ে বিক্ষোভ আয়োজন করা চরম অরুচিকর এবং পুলিশের জন্য অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করছে।”
পুলিশের মন্তব্য ও চাপ
মেট্রোপলিটন পুলিশ ফেডারেশনের চেয়ারম্যান পলা ডডস বলেন, “পুলিশ সদস্যদের মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে তুলছে এই ধারাবাহিক বিক্ষোভ। আমাদের উচিত জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কিন্তু আমরা এখন অপমানজনক প্রতিবাদের শিকার হচ্ছি।”
সরকার ও সমাজের প্রতিক্রিয়া
টোরি নেতা কেমি বাদেনোচ ও ম্যানচেস্টারের মেয়র অ্যান্ডি বার্নহ্যাম শনিবার হামলার স্থানে যান। বাদেনোচ সাংবাদিকদের বলেন, “ইহুদি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে। কেউ যদি যুক্তরাজ্য থেকে যুদ্ধক্ষেত্র ইসরায়েলে চলে যাওয়াকে নিরাপদ মনে করে, তবে এটি আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তা।”
ব্রিটিশ অভিনেতা সাচা ব্যারন কোহেন সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “এটি নাৎসি যুগের পর সবচেয়ে বড় ইহুদি-বিরোধী ঘৃণার উত্থান। কেউ যেন উপাসনায় জীবন ঝুঁকিতে না ফেলে।”
শনিবারের এই বিক্ষোভে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী ৪৯২ জন গ্রেপ্তার, যার মধ্যে প্রায় ৩০০ জন এখনও হেফাজতে রয়েছেন। মাত্র এক মাস আগের প্রতিবাদে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৮৯০ জন। সরকার, পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থা—সব পক্ষই এখন ব্রিটেনে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে।