বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। প্রতিদিন এখানে নোঙর করছে অসংখ্য জাহাজ, নামছে পণ্য, যাচ্ছে রপ্তানির মালামাল। কিন্তু এই বন্দর ব্যবস্থাপনার নানা অসংগতি ও অতিরিক্ত খরচে শিপিং এজেন্টরা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সমস্যা এতটাই তীব্র হয়েছে যে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএএ) সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
বেতন বৃদ্ধি থেকে ট্যারিফ জটিলতা
এজেন্টদের অন্যতম অভিযোগ হলো, বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতি বছর ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত, যা কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন ছাড়া প্রাক্তন নৌপরিবহন মন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে চালু করা হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং খরচের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি ঘোষিত নতুন ট্যারিফ। বন্দরের শুল্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি অফডক চার্জ ৪৪ শতাংশ এবং বার্থ অপারেটরের রেট ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আমদানির ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। ফলে বাণিজ্য খরচ একের পর এক বেড়ে যাচ্ছে।
কার্গো ডেলিভারির অনিয়ম ও ভিড়
বিশ্বের অন্যান্য বন্দরে পণ্য সরাসরি বন্দরের ভেতর থেকে ডেলিভারি হয় না, অথচ চট্টগ্রামে এখনো বেশিরভাগ পণ্য বন্দরের ভেতরেই হস্তান্তর করা হয়। এতে জটিলতা ও ভিড় বাড়ছে, কর্মক্ষমতা কমছে। বিএসএএ প্রস্তাব দিয়েছে, সব কনটেইনার অফডকে সরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে ডেলিভারি দিতে হবে।
বিপজ্জনক পণ্য ও রিফার কনটেইনার সমস্যা
বিপজ্জনক পণ্য (ডিজি কার্গো) সংরক্ষণে অতিরিক্ত জরিমানা এবং অযৌক্তিক শর্তের অভিযোগ তুলেছে এজেন্টরা। তারা বলছে, এসব জরিমানার দায় আসলে আমদানিকারকের, অথচ ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিপিং এজেন্টদের। একইভাবে রিফার কনটেইনার দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয়, যেটি পরিশোধের সামর্থ্য নেই তাদের। প্রস্তাব করা হয়েছে, ৩০ দিনের মধ্যে এসব কনটেইনার নিলামে বিক্রি অথবা এলসি ওপেনিং ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হোক।
অচল ক্রেন ও যন্ত্রপাতি
বন্দর ব্যবস্থাপনার আরেকটি বড় সমস্যা হলো যন্ত্রপাতির অকার্যকারিতা। ১৯৬০-এর দশকে স্থাপিত জেটি ক্রেন এখন আর কার্যকর নয়, তবুও এগুলোর নামে বিল আদায় চলছে। আবার আধুনিক গ্যান্ট্রি ক্রেন ও অন্যান্য সরঞ্জামের ঘনঘন বিকল হয়ে পড়ায় জাহাজ চলাচলে ব্যাপক দেরি হচ্ছে।
অফডকের বাড়তি চার্জ
অফডক অপারেটরদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। কোনো নিয়ম না মেনে তারা ৩৪ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ বাড়িয়েছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একটি কমিটির মাধ্যমে সরকার এসব হার নির্ধারণ করার কথা। সরঞ্জাম সংকটের কারণে রপ্তানি কনটেইনারও সময়মতো শিপমেন্ট হচ্ছে না।
এনবিআর ও কাস্টমসের জটিলতা
এজেন্টরা বলছেন, কাস্টমসে নানান অযৌক্তিক নিয়মে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যেমন, আমদানিকৃত পণ্যের সাধারণ ঘোষণায় (IGM) সংশোধনের সময়সীমা আগে ছিল ৩০ দিন, এখন তা নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়। কিন্তু এত অল্প সময়ে সব কাগজপত্র জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। এর ফলে অকারণে জরিমানার বোঝা বইতে হচ্ছে।
এছাড়া এখনো অনলাইনে ফাইনাল এন্ট্রি জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়নি। বর্ষাকালে বা ঝড়ো আবহাওয়ায় জাহাজে গিয়ে কাগজ জমা দেওয়া জীবনঝুঁকির সমান। শিপিং এজেন্টরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনলাইন প্রক্রিয়া চালু করাই একমাত্র যৌক্তিক সমাধান।
বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব
শিপিং এজেন্টদের মতে, এসব সমস্যার সমাধান না হলে শুধু তাদের ব্যবসা নয়, গোটা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যই হুমকির মুখে পড়বে। কারণ বন্দরের দক্ষতা কমলে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বেড়ে যাবে, বিদেশি প্রিন্সিপালরা বাংলাদেশকে অবিশ্বস্ত বাজার হিসেবে দেখতে শুরু করবেন।
সমাধানের আহ্বান
বিএসএএ প্রস্তাব দিয়েছে—
- ট্যারিফ ও বেতন বৃদ্ধির অযৌক্তিক আদেশ বাতিল
- সব কনটেইনার অফডকে সরিয়ে নেওয়া
- বিপজ্জনক পণ্যের জরিমানা আমদানিকারকের কাছ থেকে আদায়
- রিফার কনটেইনার দ্রুত নিলামে বিক্রি
- অচল ক্রেনের নামে বিল বন্ধ
- অনলাইনে ফাইনাল এন্ট্রি জমা
- আনোয়ারায় নতুন আইসিডি প্রতিষ্ঠা
- ভ্যাট ও ট্যাক্সকে ‘সেবা রপ্তানি’ হিসেবে অব্যাহতি
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এখানকার প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু শিপিং খাত নয়, আমদানি-রপ্তানি নির্ভর পুরো অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। তাই শিপিং এজেন্টদের এই সমস্যাগুলোকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেয়, তবে বন্দর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়বে, আর বৈদেশিক বাণিজ্য আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে।