Home Second Lead কৃষকের শরীরে বিষ: দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি

কৃষকের শরীরে বিষ: দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি: এআই

বিষের ছায়ায় কৃষি ও জনস্বাস্থ্য: পর্ব-৩ 

তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশের কৃষিজমিতে আজও দিনে দিনে যত ফসল ফলছে, তার পেছনে থাকে লক্ষ কৃষকের পরিশ্রম। কিন্তু এই পরিশ্রমের মাঝেই লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য বিপদ, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারজনিত বিষক্রিয়া। মাঠে কাজ করা কৃষকের শরীরে প্রতিদিন অল্প অল্প করে জমে থাকা এই বিষ দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। অনেক সময় তারা জানতেও পারেন না, অসুস্থতার মূল উৎস ঠিক কোথায়।

গ্রামের মাঠে গেলে দেখা যায়, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্প্রে মেশিন কাঁধে ঝুলিয়ে কৃষকেরা নিরলসভাবে কাজ করছেন। অনেকের গায়ে নেই সুরক্ষামূলক পোশাক, নেই গ্লাভস বা মাস্ক। ধুলাবালির সঙ্গে বাতাসে উড়ে আসা রাসায়নিক কণা অনায়াসে শরীরে ঢুকে পড়ে। স্প্রে করার সময় চোখে জ্বালা বা মাথা ঘোরা, এগুলো অনেকেই স্বাভাবিক মনে করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সামান্য অসুবিধার আড়ালে দীর্ঘমেয়াদি বিপদের ইঙ্গিতই লুকিয়ে থাকে।

গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর চিকিৎসকেরা বলছেন, অনেক কৃষকই শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, চর্মরোগ, বমি ভাব ও দুর্বলতার মতো উপসর্গ নিয়ে নিয়মিত আসেন। তবে তারা প্রাথমিকভাবে এই উপসর্গকে সাধারণ রোগ হিসেবে দেখেন, কারণ চিকিৎসার সময় প্রায়ই রাসায়নিক সংস্পর্শের বিষয়টি উল্লেখ করা হয় না। ফলে সমস্যার প্রকৃত কারণ দীর্ঘদিন অজানা থেকে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক কীটনাশকে এমন উপাদান থাকে যা স্নায়ুতন্ত্রের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলো স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে, মেজাজের পরিবর্তন ঘটাতে পারে কিংবা স্নায়বিক দুর্বলতা তৈরি করতে পারে। কিছু নিষিদ্ধ বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব আরও ভয়াবহ—ফুসফুস, যকৃত ও কিডনির স্থায়ী ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে। অনিয়মিত ব্যবহার করলে এসব রাসায়নিক রক্তে শোষিত হয়ে শরীরে বছরের পর বছর জমে থাকে।

একজন কৃষকের গল্প এই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে। কুষ্টিয়ার কৃষক মোজাম্মেল হোসেন কয়েক বছর ধরে স্প্রে করার পর হাত-পায়ে ব্যথা ও অসাড়তা অনুভব করেন। প্রথমদিকে তিনি ভাবতেন, অতিরিক্ত কাজের চাপেই এমন হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে গেলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক কীটনাশকের সংস্পর্শে থাকার কারণে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে। সঠিক চিকিৎসা না পেলে অবস্থার আরও অবনতি হতে পারত।

স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আছে সামাজিক বাস্তবতা। অনেক কৃষকই বিষ ব্যবহারের নিয়ম জানেন না বা জানলেও মানতে পারেন না। কারণ তারা মনে করেন, বেশি স্প্রে করলে পোকা দ্রুত মরবে এবং ফলন বাড়বে। আবার সুরক্ষা উপকরণ কেনা তাদের কাছে বাড়তি খরচ। বাজারেও এসব উপকরণ সহজলভ্য নয়। ফলে প্রতিদিন স্বাস্থ্যঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

জাতীয় পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালালেও মাঠপর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ এখনও সীমিত। সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকায় কৃষকেরা রাসায়নিক ব্যবহারের সঠিক মাত্রা, নিষিদ্ধ উপাদানের তালিকা বা ‘কারেন্সি পিরিয়ড’ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পান না। ফলে খণ্ডিত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আর সেই সিদ্ধান্তই কখনও কখনও তাদের জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।

চিকিৎসক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কৃষকের নিরাপত্তা সামগ্রীর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রাসায়নিক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ এবং মাঠে নজরদারি—এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। নতুবা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদক শ্রেণি এক নীরব বিপদের মুখোমুখি হতে থাকবে।

পরবর্তী পর্বে থাকছে
পানির ভিতরে লুকানো বিপদ: ভূগর্ভস্থ ও খাল-বিলের রাসায়নিক দূষণ

লাইক দিন 👍, শেয়ার করুন 🔁, এবং মন্তব্যে জানান আপনার মতামত!