মন্তব্য প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখন এক নতুন বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পোস্টার সর্বস্ব রাজনীতি। শহর থেকে গ্রাম, অলিগলি থেকে ব্যস্ত সড়ক সবখানেই দেখা যাচ্ছে নানা রঙের, বিশাল আকারের রাজনৈতিক পোস্টার। কারও জন্মদিন, কারও রাজনৈতিক বার্তা, আবার কেউ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন দলীয় নেতাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত ব্যয়বহুল এই প্রচারকার্য কেন? কার উদ্দেশ্যে? এবং এর প্রকৃত উপকারভোগী কে?
একটা সময় রাজনীতি মানেই ছিল ত্যাগ, আদর্শ আর জনসেবার মানসিকতা। আজ তা অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে নিজের নাম, ছবি আর পরিচয় ছাপিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায়। রাজনৈতিক দলের ভেতরে উপদলভিত্তিক বিভক্তি এবং একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা এখন পোস্টারে প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ নিজেকে ‘নেতার বিশ্বস্ত সৈনিক’ বলছেন, কেউ আবার ‘জননেতার অনুসারী’। দলীয় উচ্চপদস্থ নেতার দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে অনেকেই এই পোস্টার-রাজনীতিতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন। বাস্তবিক চিত্র হলো—এটি আর নিছক রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং এক ধরনের আত্মপ্রচারের উন্মাদনা।
আরও ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হচ্ছে, এই পোস্টার সংস্কৃতির আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছে অপরাধী গোষ্ঠী। অনেক এলাকায় এমন সব ব্যক্তি নিজেদের বড় নেতার অনুসারী দাবি করে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও দখলবাজির মতো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। পোস্টারে নিজের রাজনৈতিক পরিচয় জাহির করে তারা যেন একপ্রকার সামাজিক বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করছে। এতে রাজনীতির প্রকৃত চেহারা আড়াল হয়ে যাচ্ছে, এবং সাধারণ মানুষের ভরসা দুর্বল হচ্ছে।
রাজনীতিকে আদর্শের জায়গা থেকে সরিয়ে এনে যখন তা শুধুই প্রচারণা, আত্মপ্রকাশ এবং নেতার আশীর্বাদ পাওয়ার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়। পোস্টার-ভিত্তিক পরিচিতি নয়, একজন রাজনীতিকের মূল্যায়ন হওয়া উচিত তার সামাজিক ভূমিকা, নীতিনিষ্ঠতা ও ত্যাগের ভিত্তিতে। দলগুলোরও উচিত, এই পোস্টারনির্ভর সংস্কৃতি নিরুৎসাহিত করা। এর পরিবর্তে কর্মীদের কার্যকর সমাজসেবা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জনসম্পৃক্ততার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
আমাদের রাজনীতি যতদিন পোস্টারে আটকে থাকবে, ততদিন জনগণের আস্থাও সীমিত থাকবে রঙিন কাগজে। প্রয়োজন এখন এমন নেতৃত্বের, যারা পোস্টারে নয়—মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবেন তাদের কার্যক্রম, আচার ও আদর্শ দিয়ে।