Home Third Lead ইতিহাসে প্রথমবার: ডলারের সামনে ৯০-এর গণ্ডি ছাড়াল ভারতীয় রুপি

ইতিহাসে প্রথমবার: ডলারের সামনে ৯০-এর গণ্ডি ছাড়াল ভারতীয় রুপি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতীয় অর্থনীতির জন্য বুধবার (৩ ডিসেম্বর) ছিল একটি উদ্বেগজনক দিন। ইতিহাসের পাতায় এই প্রথমবার মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রার মান ৯০ টাকার গণ্ডি অতিক্রম করে খাদের কিনারায় পৌঁছেছে। শেয়ার বাজার বা ফরেক্স এক্সচেঞ্জের জটিল সমীকরণ ছাড়িয়ে এই পতনের সরাসরি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে।

পতনের নেপথ্যে ত্রিমুখী সংকট
টাকার এই নজিরবিহীন দরপতনের পেছনে বাজার বিশ্লেষকরা মূলত তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন:

১. মার্কিন বাণিজ্য শুল্কের ভীতি: আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং ভারতীয় পণ্যের ওপর সম্ভাব্য ৫০ শতাংশ ট্যারিফ বা শুল্ক আরোপের আশঙ্কা দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
২. বিদেশি লগ্নির ভাটা: চলতি বছরের শুরু থেকেই ভারতের বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এই মূলধন প্রত্যাহারের ধারা অব্যাহত থাকায় টাকার ওপর চাপ বেড়েছে।
৩. রিজার্ভ ব্যাংকের নীতি পরিবর্তন: রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) তাদের নীতিতে কৌশলগত পরিবর্তন এনেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) ভারতের বিনিময় হারকে এখন ‘স্থিতিশীল’ বা স্টেবিলাইজড-এর বদলে ‘ক্রল লাইক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আরবিআই এবার টাকাকে রক্ষা বা ‘গার্ডিং’-এর পরিবর্তে ‘গাইডিং’ বা দিকনির্দেশনার নীতি গ্রহণ করেছে। যদিও তাদের ভাণ্ডারে ৬৯ হাজার কোটি ডলার মজুদ রয়েছে, তবু দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিস্থাপকতার স্বার্থে তারা বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে না।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ডলার শক্তিশালী হওয়ার কারণে রুপির পতন হয়েছিল। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন; ডলারের সূচক স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় মুদ্রার এই পতন অর্থনীতিবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

মধ্যবিত্তের রান্নাঘর থেকে সন্তানের বিদেশ যাত্রা: কোথায় পড়বে প্রভাব?
রুপির এই অবমূল্যায়ন কেবল বড় ব্যবসায়ীদের নয়, সাধারণ মানুষের পকেটেও টান দেবে।

জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি: ভারত তাদের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৯০ শতাংশ এবং ভোজ্য তেলের প্রায় ৬০ শতাংশই আমদানি করে। ডলারের দাম বাড়ার ফলে এই পণ্যগুলোর আমদানি খরচ বাড়বে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে স্থানীয় বাজারে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ল্যাপটপ, ফ্রিজ ও স্মার্টফোনের দামও বাড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

বিদেশে শিক্ষার খরচ: টাকার পতনে সবচেয়ে বিপাকে পড়বেন বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশে কোনো কোর্সের ফি যদি ৫০ হাজার ডলার হয়, তবে ডলার ৮০ টাকা থাকাকালে খরচ হতো ৪০ লাখ টাকা। এখন ৯০ টাকা হওয়ায় সেই খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টাকায়। পাশাপাশি ডলারে নেওয়া শিক্ষা ঋণের ইএমআই-ও বেড়ে যাবে।

ভ্রমণ খরচ: বিদেশে ভ্রমণের স্বপ্নও এখন ব্যয়সাপেক্ষ। ২ হাজার ডলারের একটি ফ্যামিলি ট্রিপের খরচ আগে যেখানে ১.৬ লাখ টাকা ছিল, এখন তা বেড়ে ১.৮ লাখ টাকায় পৌঁছাবে।

কারা লাভবান হবেন?
মুদ্রার এই পতনে অবশ্য মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। যারা বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান, তাদের পরিবার আগের চেয়ে বেশি টাকা পাবেন। যেমন—বিদেশে কর্মরত কেউ ৫০০ ডলার পাঠালে এখন তার পরিবার টাকার অংকে বেশি মূল্য পাবে। এছাড়া আইটি ফার্ম এবং রপ্তানিকারকরা (এক্সপোর্টার), যারা ডলারে আয় করেন এবং টাকায় খরচ করেন, তারা সাময়িকভাবে লাভবান হতে পারেন।

করণীয় কী?
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, আগামী দিনে টাকার মান আরও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ:

যাদের আয় ভারতীয় মুদ্রায়, তারা যেন ভুলেও ডলারে কোনো ঋণ না নেন।

বিদেশে টিউশন ফি বা বড় পেমেন্টের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দরে চুক্তি (ফিক্সড রেট) করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত বাড়তি সুবিধা দেশের ভেতরেই বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে, ডলারের বিপরীতে টাকার এই রেকর্ড পতন ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি সতর্কবার্তা, যার আঁচ খুব শিগগিরই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খরচে অনুভূত হতে পারে।