Home Second Lead তিস্তার বুকে স্বপ্নের মওলানা ভাসানী সেতু: উত্তরাঞ্চলে নতুন ভোর

তিস্তার বুকে স্বপ্নের মওলানা ভাসানী সেতু: উত্তরাঞ্চলে নতুন ভোর

নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: তিস্তার বুকে হাজারো স্বপ্ন বুনে অবশেষে দাঁড়িয়ে গেল উত্তরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত অবকাঠামো—‘মওলানা ভাসানী সেতু’। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের পাঁচপীর বাজার থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা সদর পর্যন্ত এই সেতুটি শুধু ইট-পাথরের সংযোগ নয়; এটি দুই জেলার মানুষের দীর্ঘ দুর্ভোগের অবসান এবং উন্নয়নের নতুন সূচনা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান

বিগত কয়েক দশক ধরে তিস্তার দুই তীরের মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি স্থায়ী সেতুর। বর্ষায় নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার, শীতে পাড়ি দিতে হতো ফেরিঘাটের দুর্ভোগ। চিলমারীর কৃষক, সুন্দরগঞ্জের ব্যবসায়ী কিংবা শিক্ষার্থীরা সবাই একই কষ্টের সাক্ষী। সেই কষ্টের অবসান হলো আজ বুধবার (২০ আগস্ট ২০২৫) দুপুরে, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটির উদ্বোধন করলেন।

আধুনিক প্রকৌশলের নিদর্শন

৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট গার্ডার সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৯০ মিটার এবং প্রস্থ ৯.৬০ মিটার। এতে রয়েছে দুটি লেন এবং ৩১টি স্প্যান। অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার (জিওবি), সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) ও ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওফিড)। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এটি শুধু একটি অবকাঠামো নয়—পুরো উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ধারা পাল্টে দেওয়ার মতো প্রকল্প।

মানুষের মুখে আনন্দের ঝলক

চিলমারীর কৃষক আব্দুল করিম বলেন, “আগে ধান বা সবজি বিক্রি করতে হলে দিনভর কষ্ট করতে হতো। নৌকা, ফেরি—সব মিলিয়ে খরচও বেশি পড়ত। এখন ট্রাকে করে সরাসরি রাজধানী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে।”
শিক্ষার্থী রত্না খাতুনের চোখে স্বস্তির হাসি, “কলেজে যেতে নৌকা পার হতে হতো। ঝড়-বৃষ্টিতে ভয়ে থাকতাম। আজ থেকে আমাদের কষ্ট শেষ।”
সুন্দরগঞ্জের ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির আশা করছেন, “এই সেতুর কারণে বাজারগুলো জমে উঠবে। নতুন শিল্পকারখানাও গড়ে উঠবে।”

উন্নয়নের নতুন দিগন্ত

সেতুর ফলে গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হলো। কৃষিপণ্য, মাছ ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য পরিবহন সহজ হবে। উত্তরাঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ দূরত্ব ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমে আসবে। ফলে খরচ কমবে, সময় বাঁচবে, আর বাণিজ্যে আসবে গতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুরুঙ্গামারী স্থলবন্দর হয়ে ভারত ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এ সেতু।

পর্যটনের সম্ভাবনা

তিস্তার বুকে দণ্ডায়মান এই সেতু ঘিরে নতুন করে পর্যটনের সম্ভাবনাও উন্মোচিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই স্থানীয় উদ্যোক্তারা রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন। তিস্তার মনোরম দৃশ্য দেখতে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় করবেন বলে আশা করছেন স্থানীয়রা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

জাতীয় নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্মৃতিকে অমর রাখতে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। মজলুম জননেতা ভাসানী ছিলেন তিস্তা তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের মুক্তি ও অধিকারের কণ্ঠস্বর। তার আদর্শের প্রতীক হয়ে এই সেতু দাঁড়িয়ে থাকবে—এমনটাই বিশ্বাস স্থানীয়দের।

নতুন ভোরের প্রত্যাশা

সেতুর উদ্বোধনের দিন স্থানীয়দের চোখেমুখে ছিল আনন্দ ও গর্বের ছাপ। কারও চোখে জল, কারও মুখে হাসি সব মিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ ভুলে উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন আগামীর স্বপ্ন দেখছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, শিল্প ও পর্যটনের নতুন দিগন্তে পা রাখার প্রত্যাশায় তিস্তার দুই পাড় আজ একসূত্রে গাঁথা।


📌 সেতুর মূল তথ্যসংক্ষেপ

  • নাম: মওলানা ভাসানী সেতু
  • অবস্থান: গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ (পাঁচপীর বাজার) ↔ কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা সদর
  • দৈর্ঘ্য: ১,৪৯০ মিটার
  • প্রস্থ: ৯.৬০ মিটার
  • লেন সংখ্যা: ২টি
  • স্প্যান সংখ্যা: ৩১টি
  • ব্যয়: ৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা
  • অর্থায়ন: বাংলাদেশ সরকার (জিওবি), সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি), ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওফিড)
  • সুবিধা: ৪০–৬০ কিলোমিটার যোগাযোগ দূরত্ব হ্রাস, কৃষিপণ্য ও শিল্পজাত দ্রব্য পরিবহন সহজতর, নতুন শিল্প ও পর্যটনের সম্ভাবনা