সাত ফুটের বেশি উচ্চতা, তবুও অদম্য মনোবল
আমিরুল মোমেনিন
ভিড়ের মধ্যে তাঁকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে হয় না। সবার চেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটি যেন এক জীবন্ত বিস্ময়! তিনি রুমেইসা গেলগি (Rumeysa Gelgi)। তুরস্কের এই তরুণী বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা জীবিত নারী। তবে তাঁর এই আকাশছোঁয়া উচ্চতা কেবল কোনো সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক কঠিন শারীরিক লড়াই এবং অদম্য মনোবলের গল্প।
রেকর্ডের পাতায় রুমেইসা
১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি তুরস্কে জন্মগ্রহণ করা রুমেইসা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন আর দশটা শিশুর চেয়ে আলাদা। ২০১৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ‘বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা কিশোরী’ হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখান। তখন তাঁর উচ্চতা ছিল প্রায় ৭ ফুট।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উচ্চতা আরও বেড়েছে। ২০২১ সালে গিনেস কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁকে মাপেন। সেবার তাঁর উচ্চতা দাঁড়ায় ২১৫.১৬ সেন্টিমিটার বা ৭ ফুট ০.৭ ইঞ্চিতে। এই মাপের পরই তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা জীবিত নারী’-র মুকুট দেওয়া হয়। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই রেকর্ড আজও তাঁর দখলেই রয়েছে।
কেন এই অস্বাভাবিক উচ্চতা?
রুমেইসার এই বিস্ময়কর উচ্চতা কোনো জাদুকরী বিষয় নয়, বরং এটি একটি বিরল জিনগত অবস্থার ফল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘উইভার সিনড্রোম’ । এটি অত্যন্ত বিরল একটি জেনেটিক কন্ডিশন, যার ফলে মানুষের হাড় ও শরীর অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়।
এই সিনড্রোমের কারণে রুমেইসাকে প্রতিনিয়ত নানাবিধ শারীরিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। তাঁর হাড়ের বয়স শরীরের বয়সের চেয়ে দ্রুত বাড়ে, ফলে স্কেলেটাল বা কঙ্কালতন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। চলাফেরার জন্য তাঁকে প্রায়ই হুইলচেয়ার বা ওয়াকারের সাহায্য নিতে হয়। দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আটকে রাখতে পারেনি স্বপ্নকে
শারীরিক সীমাবদ্ধতা হয়তো রুমেইসার গতি কমিয়ে দিয়েছে, কিন্তু থামিয়ে দিতে পারেনি। তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো বাধাই বড় নয়। পেশাগত জীবনে তিনি একজন সফল ওয়েব ডেভেলপার। প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি তিনি নিজের পরিচিতিকে ব্যবহার করছেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে।
রুমেইসা বলেন, “ভিন্নতা মানেই দুর্বলতা নয়।” তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন শারীরিক বৈচিত্র্য এবং ‘উইভার সিনড্রোম’-এর মতো বিরল রোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে। তাঁর মতে, নিজের শারীরিক ত্রুটি বা ভিন্নতাকে লুকিয়ে না রেখে সেটাকে গ্রহণ করাই আসল সাহসিকতা।
ইতিহাসের পাতা ও বাস্তবতা
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সর্বকালের সবচেয়ে লম্বা নারী ছিলেন চীনের জেং জিনলিয়ান , যিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তাই ‘জীবিত’ নারীদের মধ্যে রুমেইসাই এখন শীর্ষ।
রুমেইসা গেলগি আজ কেবল একটি রেকর্ডের নাম নয়, তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুপ্রেরণা। ৭ ফুটের ওপরের উচ্চতা তাঁকে বিশ্বের দিকে তাকাতে বাধ্য করে ঠিকই, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বকে তাঁর দিকে শ্রদ্ধার চোখে তাকাতে শেখায়। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—শারীরিক গঠন যেমনই হোক, নিজের স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাসই মানুষকে সত্যিকারের উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।










