Home Third Lead উদ্ধারকাজে বড় এক্সকেভেটর: গভীর রাতেও সাজিদকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড়

উদ্ধারকাজে বড় এক্সকেভেটর: গভীর রাতেও সাজিদকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড়

ছবি: সংগৃহীত

 গর্তে ১৫ ঘণ্টা: সাজিদের জন্য প্রার্থনায় দেশ

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, রাজশাহী:  তানোর উপজেলার কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রাম। ঘড়ির কাটায় সময় গড়িয়েছে ১৫ ঘণ্টার বেশি। চারদিকে গভীর অন্ধকার, কিন্তু ধানখড়ের মাঠে জ্বলছে ফ্লাডলাইটের তীব্র আলো। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে এক শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। এক্সকেভেটরের যান্ত্রিক গর্জনে মাটি সরছে, আর তার পাশেই উৎকণ্ঠায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো মানুষ। ৪০ ফুট গভীর অন্ধকূপে আটকে আছে দুই বছরের ছোট্ট শিশু সাজিদ। পুরো জাতি এখন তার ফিরে আসার অপেক্ষায়।

এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি খনন করা হচ্ছে।-ছবি: সংগৃহীত

বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর সোয়া ১টার সেই অভিশপ্ত মুহূর্তের পর থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের পাতা এক করতে পারেনি সাজিদের পরিবার ও এলাকাবাসী। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মাটির নিচ থেকে ‘বুকের মানিক’কে অক্ষত ফিরিয়ে আনার।

ঘটনাস্থলের বর্তমান পরিস্থিতি

তানোর উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ বলেন, শিশুটি যে গর্তে পড়েছিল, আমরা সেই গর্তে ক্যামেরা ফেলেছিলাম। কিন্তু ৩৫ ফুট যাওয়ার ক্যামেরা আটকে যায়। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই স্থানীয়রা শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল। অসাধারণতা বসত ওই গর্তে মাটি এবং খরকুটা পড়ে যায়। ফলে ক্যামেরার মাধ্যমে শিশুটির সন্ধান পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ক্যামেরা ৩৫ ফুট মাটির নিচে গিয়ে আটকে গেছে, সেহেতু আমাদের ধারণা তার নিচেই শিশুটির অবস্থান। এজন্য রাতভর তিনটি এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি খনন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৪০ ফুট গভীর গর্ত করা হয়েছে। আর কিছু সময়ের মধ্যে যে গর্তটি করা হয়েছে সেটি দিয়ে সুড়ঙ্গ করে শিশুটির সন্ধান করতে পারব।

সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্ধারকাজে গতি আনতে বুধবার রাত পৌনে ২টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এক্সকেভেটর। এর আগে রাত ৮টার দিকে মোহনপুর থেকে আনা ছোট দুটি এক্সকেভেটর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল মাটি কাটার কাজ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মূল গর্তের সমান্তরালে বিশাল আকারের গর্ত খুঁড়ছেন। গর্তে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে প্রস্তুত রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ও মেডিক্যাল টিম।

তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, মাটির নিচে শিশুটির অবস্থান এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, বুধবার বিকেলে এবং রাত ১০টায় দুই দফায় ক্যামেরা নামানো হয়েছিল। কিন্তু ওপর থেকে ধসে পড়া মাটি ও খড়কুটার কারণে ক্যামেরায় শিশুটিকে দেখা যায়নি। পাইপের ভেতরটা এখন নিস্তব্ধ।

সাজিদ

মায়ের আর্তনাদ ও সেই শেষ ডাক
ঘটনাস্থলের অদূরেই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন সাজিদের মা রুনা খাতুন। বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন সেই দুঃসহ মুহূর্তের কথা। দুই সন্তানকে নিয়ে দুপুরে বাড়ির পাশের মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে ‘মা’ বলে চিৎকার। ফিরে দেখেন ছেলে নেই। খড়ের গাদার নিচে যে পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের মরণফাঁদ লুকিয়ে ছিল, তা বুঝতে পারেনি অবুঝ শিশুটি। রুনা খাতুন বলেন, “আমার ছেলেটা মা বলে ডাকল, তারপর সব চুপ। আমি গর্তের কাছে গিয়ে দেখি ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ আসছে, একটু পর সেটাও থেমে গেল।”

উদ্ধারে বিলম্ব ও ক্ষোভ
স্থানীয়দের মাঝে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। দুপুর ১টায় ঘটনা ঘটলেও ঘটনাস্থলে প্রথম এক্সকেভেটর পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় ৭ ঘণ্টা।

স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুস সাকিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শিশুটা দুপুরে পড়লো, আর মাটি কাটার মেশিন আসলো রাতে। তাও ছোট মেশিন। প্রশাসন যদি শুরুতেই বড় এক্সকেভেটর দিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করত, তবে হয়তো এতক্ষণে ছেলেটাকে আমরা কোলে পেতাম। তানোরের মতো একটা উপজেলায় কেন ইমার্জেন্সি রেসপন্সের সরঞ্জাম থাকবে না?”

তবে বিলম্বের বিষয়ে তানোর উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ম্যানেজার আব্দুর রউফ বলেন, “আমরা খবর পাওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করছি। কিন্তু তানোর উপজেলায় কোনো এক্সকেভেটর পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে মোহনপুর থেকে মেশিন আনতে হয়েছে। এখন বড় মেশিন এসেছে, আমরা আশা করছি দ্রুতই শিশুটির কাছে পৌঁছাতে পারব।”

জনস্রোত ও চ্যালেঞ্জ
উদ্ধার কাজের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়। হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় করায় মাটি কাটার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা হিমশিম খাচ্ছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, পাইপটি মাত্র ৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের এবং ৩৫ থেকে ৪০ ফুট গভীর। মাটি নরম হওয়ায় ধসে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে, যা উদ্ধার কাজকে আরও জটিল করে তুলেছে।

অপেক্ষার প্রহর
 শঙ্কা  বাড়ছে। তবে হাল ছাড়েননি উদ্ধারকর্মীরা। এক্সকেভেটরের থাবায় উঠে আসছে মাটি, আর তার সাথে উঠে আসছে হাজারো মানুষের প্রার্থনা। সবার একটাই চাওয়া—যান্ত্রিক ত্রুটি আর প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতাকে হারিয়ে ছোট্ট সাজিদ আবার মায়ের কোলে ফিরে আসুক। সাজিদ কি ফিরবে? নাকি পাইপের অন্ধকূপই হবে তার শেষ ঠিকানা? এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই এখন সময়ের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ।