হেলথ ডেস্ক: চীনের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ফেলে দেওয়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশ বা ‘বাট’ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু ছড়ানোর এক নতুন উৎসে পরিণত হচ্ছে।
চীনের ৩৫টি শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের বাট অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জিন (ARGs) বা এমন ডিএনএ খণ্ডের বিস্তার ঘটায় যা ব্যাকটেরিয়াকে ওষুধ প্রতিরোধী করে তোলে এবং ‘সুপারবাগ’ তৈরি করে।
গবেষণার ফলাফল
বিজ্ঞানীরা ১০০টিরও বেশি পাবলিক পার্ক থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। সেখানে দেখা যায়, ধূমপায়ীর মুখের ‘অপর্চুনিস্টিক’ ব্যাকটেরিয়া সিগারেটের ক্ষতিকর রাসায়নিকের সঙ্গে মিশে দ্রুত বংশবিস্তার ও রূপান্তর ঘটায়। পরে যখন সিগারেটের বাট মাটিতে ফেলা হয়, তখন এই ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
গবেষকরা ৯৫টিরও বেশি ব্যাকটেরিয়া প্রজাতি শনাক্ত করেছেন, যারা সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করেছে এবং ফেলে দেওয়া সিগারেটের পৃষ্ঠে টিকে আছে।
তাদের মতে, এসব ব্যাকটেরিয়া পার্কের গাছপালা, প্রাণীজগৎ এমনকি মানুষের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে—যদি কেউ দুর্ঘটনাবশত এসবের সংস্পর্শে আসে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি Proceedings of the National Academy of Sciences (PNAS) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়:
“সিগারেটের বাট জনসমাগমস্থলে এক অদৃশ্য মাইক্রোবিয়াল ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অবমূল্যায়িত ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।”
গবেষকেরা আরও উল্লেখ করেন, “শহুরে উন্মুক্ত সবুজ জায়গাগুলো—যেখানে মানুষ পিকনিক করে, ব্যায়াম করে বা শিশুরা খেলাধুলা করে—সেখানে এই ফেলে দেওয়া সিগারেটের কারণে জীবাণু দূষণ বেড়ে চলেছে।”
তারা পরামর্শ দেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলোকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
‘মানবজাতির জন্য নীরব হুমকি’
বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সকে ‘নীরব মহামারি’ (silent pandemic) বলা হয়। এটি ঘটে যখন ব্যাকটেরিয়া এমনভাবে বিবর্তিত হয় যে, অ্যান্টিবায়োটিক আর তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর থাকে না। বর্তমানে এ কারণে প্রতি বছর বিশ্বে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে—এ সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে সাধারণত MRSA (methicillin-resistant Staphylococcus aureus) এবং C. difficile সংক্রমণই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যা বিশেষ করে বয়স্ক বা অস্ত্রোপচারের পর দুর্বল রোগীদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের মলিকিউলার মাইক্রোবায়োলজির লেকচারার ড. অ্যান্ড্রু এডওয়ার্ডস বলেন, “সিগারেটের বাট নিঃসন্দেহে ব্যাকটেরিয়ার ভাণ্ডার হতে পারে, তবে এটি একমাত্র উৎস নয়। ক্যান, বোতলসহ অন্যান্য বর্জ্য থেকেও একই ঝুঁকি তৈরি হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের শরীরই নানা ব্যাকটেরিয়ায় পূর্ণ, যার কিছু অংশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। এসব জীবাণু আমাদের স্পর্শ করা যেকোনো জিনিসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই সিগারেটের বাট নিয়ে আমি অতটা উদ্বিগ্ন নই, কারণ এগুলো সাধারণত কেউ ছুঁয়েও না।”
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবিয়াল জিনোমিকসের অধ্যাপক ড. স্যাম শেপার্ড বলেন, “অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মানবজাতির অন্যতম বড় জনস্বাস্থ্য সংকট। তাই সিগারেটের বাটের মতো নতুন উৎস চিহ্নিত করা গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি যোগ করেন, “মানুষ ও প্রাণীর বর্জ্য—যেকোনো উৎস থেকেই এ ধরনের জীবাণু ছড়াতে পারে, তাই সব দিকেই সতর্কতা প্রয়োজন।”
গবেষণাটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ফেলে দেওয়া সিগারেট শুধু পরিবেশ দূষণই নয়, বরং ব্যাকটেরিয়া ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ছড়ানোর এক অদৃশ্য হুমকি। তাই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা এখন সময়ের দাবি—না হলে এই নীরব বিপর্যয় ভবিষ্যতে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দেখা দিতে পারে।










