Home Third Lead দুটি দেশের এক দ্বীপ রহস্যময় সেন্ট মার্টিন

দুটি দেশের এক দ্বীপ রহস্যময় সেন্ট মার্টিন

সংগৃহীত ছবি

 বিশেষ ফিচার প্রতিবেদন 

আমিরুল মোমেনিন

বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, তা আমাদের কাছে সমুদ্রপাড়ের এক স্বপ্নরাজ্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো পৃথিবীতে একই নামে আরেকটি দ্বীপ আছে, যা অবস্থিত ক্যারিবীয় সাগরে। ছোট্ট সেই দ্বীপটির নামও সেন্ট মার্টিন, তবে এই দ্বীপটি একেবারে অনন্য কারণ এটি একসঙ্গে দুটি ভিন্ন দেশের অধীনে বিভক্ত। একপাশে ফ্রান্স, আর অন্য পাশে নেদারল্যান্ডস। এমন উদাহরণ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি ক্যারিবীয় সাগরের লেসার অ্যান্টিলিস দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত। দ্বীপটির মোট আয়তন প্রায় সাতাশি বর্গকিলোমিটার। উত্তর অংশের নাম সেন্ট মার্টিন ফরাসি প্রশাসনের অধীনে, আর দক্ষিণ অংশের নাম সিন্ট মার্টেন, যা নেদারল্যান্ডস রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। দ্বীপটি আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত, পাহাড় পর্বত, সবুজ বনভূমি ও সাদা বালির সমুদ্রসৈকতে ঘেরা। সর্বোচ্চ উচ্চতা পিক প্যারাডিস চারশ চব্বিশ মিটার। এর চারপাশে নীল সবুজ জলরাশি আর আকাশে সারাবছর গ্রীষ্মের রোদ এক কথায় পর্যটকদের স্বর্গ।

দ্বীপের আবহাওয়া একেবারে ক্রান্তীয়। বছরের বেশিরভাগ সময়ই উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল থাকে। বর্ষাকাল জুন থেকে নভেম্বর হারিকেন মৌসুম, শুষ্ক মৌসুম ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। এই আরামদায়ক আবহাওয়াই সেন্ট মার্টিনকে সারাবছর পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে।

সেন্ট মার্টিন মূলত পর্যটন নির্ভর একটি অর্থনীতি। এখানে বিশ্বখ্যাত রিসোর্ট, সৈকত ও শপিং সেন্টার রয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে মাহো বিচ, বিমানবন্দরের পাশের এই সৈকতটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত সৈকতগুলোর একটি। বিমান যখন মাথার ওপর দিয়ে প্রায় ছুঁয়ে যায়, তখন পর্যটকরা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা উপভোগ করেন। ওরিয়েন্ট বে ইউরোপীয় ধারার সৈকত সংস্কৃতির নিদর্শন; সাদা বালির লম্বা সৈকত, সারি সারি রেস্টুরেন্ট ও জলক্রীড়ার আয়োজন। ফোর্ট লুই ফরাসি অংশে অবস্থিত আঠারো শতকের পুরনো দুর্গ। এখান থেকে পুরো মারিগট উপসাগরের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। মারিগট বাজার রঙিন ফরাসি বাজার, যেখানে পাওয়া যায় হাতে তৈরি গহনা, সুগন্ধি, ফলমূল ও স্থানীয় ক্রিওল খাবার। লটেরি ফার্ম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এক প্রাকৃতিক উদ্যান, যেখানে দড়ি ঝুলে বন ভ্রমণ করা যায়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইতিহাসে রয়েছে উপনিবেশবাদ ও সংস্কৃতির মিশ্রণ। চৌদ্দশ তিরানব্বই সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস দ্বীপটি আবিষ্কার করেন এবং সেন্ট মার্টিন অব ট্যুরস নামের এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর নামে দ্বীপটির নাম রাখেন। পরবর্তী শতাব্দীতে ফরাসি ও ডাচ উপনিবেশকারীরা দ্বীপটি দখল নিয়ে একাধিক সংঘর্ষে জড়ায়। অবশেষে ষোলোশ আটচল্লিশ সালে স্বাক্ষরিত কনকর্ডিয়া চুক্তি অনুযায়ী দ্বীপটি দুই দেশের মধ্যে ভাগ হয়। এটি একটি অনন্য শান্তিপূর্ণ চুক্তি, যা আজও কার্যকর।

দ্বীপের সংস্কৃতি ইউরোপীয় ও আফ্রিকান ঐতিহ্যের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। ভাষা ফরাসি, ডাচ, ইংরেজি ও স্থানীয় পাপিয়ামেন্টো। ধর্ম প্রধানত খ্রিস্টান। উৎসব কার্নিভাল, সেন্ট মার্টিন দিবস একাদশ নভেম্বর এবং বিভিন্ন সঙ্গীত উৎসব দ্বীপজুড়ে পালিত হয়। খাবারে ক্রিওল ও ফরাসি রান্নার প্রভাব স্পষ্ট। সমুদ্রের মাছ, লবস্টার, সস এবং ট্রপিক্যাল ফলের রস এই দ্বীপের রন্ধনশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য।

সেন্ট মার্টিনের অর্থনীতি মূলত তিন খাতে নির্ভরশীল পর্যটন, বাণিজ্য ও শুল্কমুক্ত কেনাকাটা এবং আর্থিক সেবা ও রিয়েল এস্টেট। ফরাসি অংশে ইউরো এবং ডাচ অংশে গিল্ডার ও মার্কিন ডলার ব্যবহৃত হয়।

সেন্ট মার্টিনে পৌঁছানো যায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে। প্রধান বিমানবন্দর প্রিন্সেস জুলিয়ানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফরাসি অংশেও একটি ছোট বিমানবন্দর আছে লেসপেরাঁস বিমানবন্দর। দ্বীপে অবস্থানের জন্য রয়েছে বিলাসবহুল রিসোর্ট, ছোট কটেজ ও সমুদ্রতীরবর্তী হোটেল। নিরাপত্তা ও আতিথেয়তার মান অত্যন্ত ভালো।

বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন আমাদের কাছে বঙ্গোপসাগরের মণি, আর ক্যারিবীয় সেন্ট মার্টিন যেন এক রঙিন রত্ন। দুটি দ্বীপ নামের মিল রাখলেও প্রকৃতিতে ও ইতিহাসে একেবারে আলাদা। কিন্তু দুটির মাঝেই মিল রয়েছে একটিতে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পৃথিবীর মানচিত্রে এমন একটি দ্বীপ খুবই বিরল, যেখানে ফরাসি রোমান্স আর ডাচ বাস্তববাদের নিখুঁত সহাবস্থান দেখা যায়। সত্যিই সেন্ট মার্টিন এক অনন্য দ্বীপ দুটি দেশের দুটি সংস্কৃতির কিন্তু একটি হৃদয়ের।