Home কক্সবাজার বাঁচবে প্রবাল, বাঁচবে দ্বীপ: সেন্ট মার্টিনের আগামীর রূপরেখা

বাঁচবে প্রবাল, বাঁচবে দ্বীপ: সেন্ট মার্টিনের আগামীর রূপরেখা

নীল জলরাশি আর কেয়া বনের মায়া কাটিয়ে সেন্ট মার্টিন কি হারিয়ে যাবে, নাকি নতুন রূপে ফিরবে তার হারানো গৌরব?

বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্ব দক্ষিণে এক টুকরো প্রবাল দ্বীপ—সেন্ট মার্টিন। স্থানীয়দের কাছে যা ‘নারিকেল জিনজিরা’। যুগ যুগ ধরে এই দ্বীপ তার অকৃত্রিম সৌন্দর্য দিয়ে মুগ্ধ করে আসছে ভ্রমণপিপাসুদের। কিন্তু মানুষের অনিয়ন্ত্রিত পদচারণা, অপরিকল্পিত স্থাপনা আর দূষণের ভারে দ্বীপটি আজ ক্লান্ত, বিপন্ন এবং মুমূর্ষু। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই এই দ্বীপ তার প্রবাল হারাবে, তলিয়ে যাবে সমুদ্রগর্ভে।

ঠিক এই সংকটময় মুহূর্তে, দ্বীপটিকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করেছে ‘মাস্টার প্ল্যান: সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’-এর খসড়া। এটি কেবল একটি সরকারি ফাইল বা দলিল নয়; এটি ৫৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যার ওপর নির্ভর করছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির ভবিষ্যৎ।

জনগণের মতামত চায় সরকার
আলোচ্য মহাপরিকল্পনার খসড়াটি বর্তমানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পোর্টালে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। জনসাধারণ, বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগামী ২০ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রেরণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

আপনাদের সুবিধার্থে এই সব প্রশ্নের উত্তর ও মহাপরিকল্পনার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ নিয়ে আমাদের বিশেষ আয়োজন— পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন: ‘বাঁচবে প্রবাল, বাঁচবে দ্বীপ: সেন্ট মার্টিনের আগামীর রূপরেখা’

সেন্ট মার্টিন কি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে? নাকি এই মাস্টার প্ল্যানও হারিয়ে যাবে ফাইলের স্তূপে? আমাদের সাথেই থাকুন।

প্রথম পর্ব

মৃত্যুপথযাত্রী সেন্ট মার্টিন বাঁচাতে ৫৪ কোটি টাকার মহাযজ্ঞ: কী আছে মাস্টার প্ল্যানে?

কামরুল ইসলাম, ঢাকা: নীল জলের গভীরে রঙিন প্রবাল আর সৈকতের কেয়া বন, সেন্ট মার্টিনের এই চিরচেনা রূপ আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ, যত্রতত্র হোটেল নির্মাণ আর প্লাস্টিকের স্তূপে দ্বীপটি আজ ‘মৃত্যুপথযাত্রী’। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, দ্বীপটির প্রতিবেশ ব্যবস্থা এমন এক ধসের মুখে পড়েছে যে, এখনই রাশ না টানলে মানচিত্র থেকে হয়তো হারিয়ে যাবে দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপ।

এই অস্তিত্ব সংকট থেকে সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। প্রণয়ন করা হয়েছে ‘মাস্টার প্ল্যান: সেন্ট মার্টিন দ্বীপ (সেপ্টেম্বর ২০২৫)’। এটি কেবল একটি পরিকল্পনা নয়, বরং দ্বীপটিকে বাঁচানোর শেষ আইনি ও কৌশলগত দলিল।

কেন এই মাস্টার প্ল্যান?
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি ২৬৯ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ১৯৪ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। কিন্তু গত দুই দশকে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন দ্বীপটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।

পর্যটকের ভার: দ্বীপটির ধারণক্ষমতা সীমিত হলেও পিক সিজনে প্রতিদিন ৩,০০০ থেকে ৭,০০০ পর্যটক এখানে ভিড় করেন।

অবকাঠামো: ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দ্বীপে অপরিকল্পিত অবকাঠামো বেড়েছে দ্বিগুণ। কৃষিজমি ও সবুজ এলাকা ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে ১০৯টিরও বেশি হোটেল ও রিসোর্ট।

দূষণ: পর্যটকদের ফেলা বর্জ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিক এবং পয়ঃনিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনা সমুদ্রের পানি ও প্রবালকে বিষিয়ে তুলছে।

এই প্রেক্ষাপটেই দ্বীপটিকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ECA) হিসেবে রক্ষার জন্য এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।

৫৪ কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ: কী আছে পরিকল্পনায়?
মাস্টার প্ল্যানটিতে আগামী ১০ বছরের জন্য (২০২৫-২০৩৫) একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় মোট ৯টি কৌশলগত খাতে ২৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর জন্য প্রাক্কলিত বাজেট ধরা হয়েছে ৫৪৭.৯ মিলিয়ন টাকা (প্রায় ৫৪ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা)

পরিকল্পনাটি তিনটি মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে:
১. স্বল্পমেয়াদী (১-৩ বছর): জরুরি ভিত্তিতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
২. মধ্যমেয়াদী (১-৫ বছর): অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিকল্প জীবিকা।
৩. দীর্ঘমেয়াদী (১-১০ বছর): প্রবাল ও জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার।

পরিকল্পনার ৪টি মূল স্তম্ভ
মাস্টার প্ল্যানটি মূলত চারটি প্রধান স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে:
১. পর্যটন নিয়ন্ত্রণ: প্রতিদিন পর্যটকের সংখ্যা ৫,০০০-৭,০০০ থেকে কমিয়ে ৫০০-৯০০ জনের মধ্যে নামিয়ে আনা। চালু করা হবে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও ট্র্যাকিং সিস্টেম।
২. জোনিং (Zoning): পুরো দ্বীপকে ৪টি আলাদা জোনে ভাগ করা হবে। যেখানে ‘সাধারণ ব্যবহার’ এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও পর্যটকরা ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারবেন না।
৩. জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার: প্রবাল প্রাচীর, সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং ম্যানগ্রোভ বন রক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ।
৪. টেকসই ব্যবস্থাপনা: বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘জিরো ওয়েস্ট’ নীতি এবং স্থানীয়দের জন্য ব্লু-ইকোনমি ভিত্তিক বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা।

বাস্তবায়নে কারা থাকবে?
এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল দায়িত্বে থাকবে পরিবেশ অধিদপ্তর (DoE)। তবে তাদের সহায়তা করবে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (BPC), স্থানীয় সরকার এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। পরিকল্পনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

ভবিষ্যতের সেন্ট মার্টিন
সরকারের লক্ষ্য—আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিনকে একটি ‘ইকো-টুরিজম’ বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন হাব হিসেবে গড়ে তোলা। যেখানে পর্যটকরা আসবেন প্রকৃতির অতিথি হয়ে, ধ্বংসকারী হিসেবে নয়।

কিন্তু ৫৪ কোটি টাকার এই পরিকল্পনা কি পারবে শক্তিশালী সিন্ডিকেট আর পর্যটনের লোভ সামলাতে? নাকি ফাইলের স্তূপেই চাপা পড়বে সেন্ট মার্টিনের বাঁচার স্বপ্ন?

বিস্তারিত থাকছে আগামী পর্বগুলোতে।


পরবর্তী পর্ব: দিনে ৯০০ জনের বেশি পর্যটক নয়: সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসছে কঠোর বিধিনিষেধ

লাইক দিন 👍, শেয়ার করুন 🔁, এবং মন্তব্যে জানান আপনার মতামত!