Home Second Lead পর্যটন কমলে কী করবেন দ্বীপবাসী? স্থানীয়দের জন্য বিকল্প আয়ের ভাবনা

পর্যটন কমলে কী করবেন দ্বীপবাসী? স্থানীয়দের জন্য বিকল্প আয়ের ভাবনা

‘বাঁচবে প্রবাল, বাঁচবে দ্বীপ: সেন্ট মার্টিনের আগামীর রূপরেখা’
পর্ব-৬

কামরুল ইসলাম, ঢাকা: সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করা হবে—মাস্টার প্ল্যানের এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই স্থানীয় বাসিন্দাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার মানুষের অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা, ভ্যান চালানো কিংবা ডাব-মাছ বিক্রি করেই চলে তাদের সংসার।

তাই প্রশ্ন উঠেছে, পর্যটক যদি দিনে ৯০০ জনে নামিয়ে আনা হয়, তবে বাকি সময় দ্বীপবাসী খাবে কী?

পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রণীত ‘মাস্টার প্ল্যান: সেন্ট মার্টিন দ্বীপ (সেপ্টেম্বর ২০২৫)’-এ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। পরিকল্পনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, স্থানীয়দের জন্য টেকসই ও বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে, যাতে তারা পর্যটনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সারা বছর স্বচ্ছল থাকতে পারেন।

‘নারিকেল জিঞ্জিরা’র নারিকেলই হবে সম্পদ
সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’। অথচ দ্বীপের নারিকেল অবহেলায় পড়ে থাকে অথবা পর্যটকদের কাছে সস্তায় কাঁচা ডাব হিসেবে বিক্রি হয়। মাস্টার প্ল্যানের জীবিকা উন্নয়ন অংশে (প্রকল্প LI-03) নারিকেল-ভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ব্র্যান্ডিং ও প্রসেসিং: নারিকেল থেকে উন্নতমানের তেল, প্রসাধনী এবং খাদ্যদ্রব্য তৈরির জন্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে তোলা হবে।

ডিজিটাল বাজার: দ্বীপের পণ্য যাতে দেশের মূল ভূখণ্ডে বা বিদেশে বিক্রি করা যায়, সে জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং স্থানীয়রা ন্যায্যমূল্য পাবেন।

সমুদ্র মানেই শুধু মাছ নয়: ব্লু-ইকোনমি ও শৈবাল চাষ
দ্বীপের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা। কিন্তু অতিরিক্ত মৎস্য আহরণে এখন মাছের আকাল। মাস্টার প্ল্যানে (প্রকল্প FB-01) প্রচলিত মাছ ধরার বাইরে ‘ব্লু-ইকোনমি’ বা সমুদ্র অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের কথা বলা হয়েছে।

শৈবাল চাষ : সেন্ট মার্টিনের পাথর ও অগভীর জলরাশি সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য আদর্শ। বিশ্ববাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়দের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শৈবাল চাষের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দেওয়া হবে।

খাঁচায় মাছ চাষ : সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা কমাতে উপকূলের কাছাকাছি নির্দিষ্ট এলাকায় খাঁচায় মাছ চাষ বা ‘মেরিকালচার’ চালু করা হবে।

শুটকি মহাল আধুনিকায়ন: সনাতন পদ্ধতির বদলে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে শুটকি তৈরির জন্য আধুনিক ড্রায়ার ও প্রসেসিং জোন করা হবে, যা বিদেশে রপ্তানিযোগ্য হবে।

নারীদের ক্ষমতায়ন ও হস্তশিল্প
দ্বীপের নারীরা এতদিন অর্থনীতির মূল স্রোতের বাইরে ছিলেন। মাস্টার প্ল্যানের (LI-01) আওতায় নারীদের জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। পর্যটকরা যাতে প্লাস্টিকের খেলনা না কিনে স্থানীয় নারীদের তৈরি শামুক-ঝিনুকের পরিবেশবান্ধব হস্তশিল্প, নকশিকাঁথা বা স্থানীয় পোশাক কেনেন, সে ব্যবস্থা করা হবে।

ইকো-টুরিজম গাইড ও হোম-স্টে
পর্যটক কমলেও যারা আসবেন, তারা হবেন ‘ইকো-টুরিস্ট’ বা পরিবেশ সচেতন পর্যটক। তাদের জন্য দ্বীপের স্থানীয় তরুণদের ‘ইকো-গাইড’ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারা পর্যটকদের দ্বীপের জীববৈচিত্র্য, কচ্ছপের প্রজনন ক্ষেত্র এবং প্রবাল সম্পর্কে জানাবেন। এছাড়া নিয়ন্ত্রিত উপায়ে স্থানীয়দের বাড়িতে ‘হোম-স্টে’ বা আতিথেয়তা সেবা চালু করা হবে, যার মাধ্যমে আয় সরাসরি স্থানীয়দের পকেটে যাবে।

কৃষি ও অর্গানিক ফার্মিং
দ্বীপের জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে অর্গানিক সবজি চাষে উৎসাহিত করা হবে (প্রকল্প LI-02)। দ্বীপের হোটেলগুলোতে এই সবজির চাহিদা মেটানো সম্ভব হলে মূল ভূখণ্ড থেকে সবজি আনার খরচ বাঁচবে এবং কৃষকরা লাভবান হবেন।

বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
কাগজে-কলমে এই বিকল্প আয়ের পথগুলো আশাজাগানিয়া হলেও, স্থানীয়রা বলছেন ভিন্ন কথা। স্থানীয় এক প্রবীণ জেলের মতে, “আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে মাছ ধরি আর পর্যটকদের সেবা দিই। নতুন কাজ শিখতে সময় লাগবে, সরকার যদি সেই সময় পর্যন্ত আমাদের সহায়তা না দেয়, তবে না খেয়ে মরতে হবে।”

মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মতে, এই পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের মাধ্যমে স্থানীয়দের নতুন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করা হবে। এজন্য মাস্টার প্ল্যানে ৫৪৭.৯ মিলিয়ন টাকার বাজেটের একটি বড় অংশ জীবিকা উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।