Home অন্যান্য অস্তিত্বের সংকটে বাংলাদেশের মহাবলশালী প্রাণিসম্পদ

অস্তিত্বের সংকটে বাংলাদেশের মহাবলশালী প্রাণিসম্পদ

বিশেষ প্রতিবেদন

বিপন্ন বুনো হাতি

তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: একসময় বাংলাদেশের বনাঞ্চল কাঁপিয়ে বেড়াত হাতির বড় বড় পাল। ময়মনসিংহ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্য ছিল তাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। কিন্তু জঙ্গল কমে আসা, অবৈধ দখল এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে বনের রাজা আজ বাস্তুহারা। খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে এসে প্রাণ হারাচ্ছে হাতি, আবার হাতির আক্রমণে মারা যাচ্ছে মানুষ। এই দোটানায় বাংলাদেশের হাতি সম্পদ আজ এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে হাতির প্রজাতি ও সংখ্যা

বাংলাদেশে মূলত এশীয় হাতি বা Elephas maximus প্রজাতির হাতি দেখা যায়। মহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে এগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে তিন ধরনের হাতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়:

১. আবাসিক হাতি : এরা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের বনাঞ্চলে বাস করে।
২. পরিযায়ী হাতি : এই হাতিগুলো ভারতের আসাম, মেঘালয় বা মিজোরাম এবং মিয়ানমার সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসে এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফিরে যায়।
৩. বন্দি বা গৃহপালিত হাতি: বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানায়, সার্কাসে বা কাঠ টানার কাজে ব্যবহৃত হাতি।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার  এবং বন বিভাগের সর্বশেষ জরিপ (২০১৬-এর তথ্যমতে) অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্থায়ী বুনো হাতির সংখ্যা ২৬৮টি। পরিযায়ী হাতির সংখ্যা প্রায় ৯৩টি এবং গৃহপালিত হাতির সংখ্যা প্রায় ১০০টি। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ৫০০-এর নিচে, যা এই প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও কমেছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

কোথায় কোথায় হাতির বিচরণ?

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানে হাতি মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্রগুলো হলো:

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল: কক্সবাজার, চট্টগ্রাম (দক্ষিণ ও উত্তর বনবিভাগ) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। এখানেই দেশের অধিকাংশ বুনো হাতির বাস।

উত্তর-পূর্বাঞ্চল: সিলেট ও মৌলভীবাজারের কিছু বনাঞ্চল ও চা বাগান এলাকা। বিশেষ করে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় কিছু হাতির পাল দেখা যায়।

উত্তরাঞ্চল (সীমান্তবর্তী): ময়মনসিংহ, শেরপুর এবং নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় মূলত ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পরিযায়ী হাতির বিচরণ ঘটে।

 কেন লোকালয়ে আসছে হাতি?

হাতি একটি বিশাল দেহী প্রাণী, যার দৈনিক প্রায় ১৫০-২০০ কেজি খাবার এবং প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু তাদের প্রাকৃতিক খাবার এখন আর বনে নেই। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

১. প্রাকৃতিক বন ধ্বংস: হাতির প্রধান খাদ্য হলো বাঁশ, কলাগাছ, জংলি লতাগুল্ম এবং বিভিন্ন বুনো ফল। কিন্তু বন উজাড় করে সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস ও মেহগনির মতো বিদেশি গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছের পাতা হাতি খায় না এবং এসব বাগানের নিচে কোনো ঝোপঝাড় বা লতাগুল্ম জন্মায় না। ফলে বনে হাতির খাবার নেই।

২. আবাসস্থল সংকোচন: বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ, বসতি স্থাপন এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মতো বড় অবকাঠামোর কারণে হাতির চারণভূমি সংকুচিত হয়েছে।

৩. পানির অভাব: শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে যায় বা দূষিত হয়ে পড়ে, ফলে পানির সন্ধানেও হাতি লোকালয়ের দিকে ধাবিত হয়।

অবরুদ্ধ করিডর ও মানুষ-হাতি সংঘাত

হাতিরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে চলাচল করে, যাকে বলা হয় ‘এলিফ্যান্ট করিডর’। বাংলাদেশে একসময় ১২টি আন্তর্জাতিক করিডর ছিল, যার অধিকাংশই এখন মানুষের দখলে। কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের কারণে হাতির প্রধান চলাচলের পথ বা করিডরগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

পথ হারিয়ে এবং ক্ষুধার জ্বালায় হাতি যখন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে, তখন মানুষের ক্ষেতের ফসল (বিশেষ করে ধান) খেয়ে ফেলে। নিজের ফসল বাঁচাতে মানুষ বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পাতে, গুলি করে বা বিষ প্রয়োগ করে। গত কয়েক বছরে শেরপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৈদ্যুতিক ফাঁদে হাতি হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

গৃহপালিত হাতির অমানবিক জীবন

বুনো হাতির পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি বড় অংশের হাতি ব্যক্তি মালিকানাধীন। একসময় জমিদাররা বা কাঠ ব্যবসায়ীরা এদের লালন-পালন করতেন। বর্তমানে কাজ না থাকায় অনেক মালিক এই হাতিগুলোকে দিয়ে রাস্তায় চাঁদাবাজি করাচ্ছেন। ‘ফিটনেস বিহীন’ ও অসুস্থ এই হাতিগুলোকে শহরের পিচঢালা পথে হাঁটানো এবং পর্যাপ্ত খাবার না দেওয়া—প্রাণী অধিকারের চরম লঙ্ঘন। যদিও হাইকোর্ট সম্প্রতি হাতি দিয়ে চাঁদাবাজি বন্ধে এবং ব্যক্তি মালিকানায় লালন-পালনের লাইসেন্স প্রদানে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হাতি বাঁচাতে হলে সবার আগে তাদের আবাসস্থল ফিরিয়ে দিতে হবে।

  • বনের ভেতর হাতির উপযোগী খাবার বাগান (বাঁশ, কলা, ডুমুর ইত্যাদি) তৈরি করতে হবে।
  • এলিফ্যান্ট করিডরগুলোকে দখলমুক্ত করে তাদের চলাচলের পথ সুগম করতে হবে।
  • মানুষ ও হাতির সংঘাত কমাতে ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ (ERT)-এর কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।