বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: পাকিস্তানের অটোমোবাইল শিল্প ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের ধারায় রয়েছে। পাকিস্তান অটোমোটিভ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (পামা)-এর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে যাত্রীবাহী গাড়ি, এলসিভি, ভ্যান ও জিপের বিক্রি আগের মাসের তুলনায় (মাসওয়ারি ভিত্তিতে) বেড়েছে ২২ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় (বছরওয়ারি ভিত্তিতে) বেড়েছে ৬৭ শতাংশ, যা মোট বিক্রিত ইউনিট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭,১৭৪-এ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সুদের হার হ্রাস এবং ভোক্তা আস্থার উন্নতি—এই চারটি উপাদান একসঙ্গে কাজ করায় গাড়ির চাহিদা সব সেগমেন্টেই বেড়েছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি আংশিকভাবে ‘লো বেস ইফেক্ট’-এর কারণেও বেশি চোখে পড়ছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে পাকিস্তানে মোট গাড়ি বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৪২,২৬৭ ইউনিটে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি।
ব্র্যান্ডভিত্তিক বিশ্লেষণ
হোন্ডা অ্যাটলাস কারস (এইচসিএআর) সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে—সেপ্টেম্বরে তাদের বিক্রি বেড়েছে মাসওয়ারি ১১৫% ও বছরওয়ারি ৮২%, মোট বিক্রি হয়েছে ২,৩০৭ ইউনিট। কোম্পানির জনপ্রিয় মডেল সিভিক ও সিটি মিলে বিক্রি বেড়েছে বছরওয়ারি ৭৩% এবং মাসওয়ারি ২.৮ গুণ হয়ে ১,৯৭৭ ইউনিটে পৌঁছেছে। যদিও বিএর-ভি ও এইচআর-ভি মডেলের বিক্রি মাসওয়ারি ১২% কমেছে, তবুও বছরওয়ারি বৃদ্ধি ছিল ২.৬ গুণ।
পাক সুজুকি মোটর কোম্পানি (পিএসএমসি) ছোট গাড়ির বাজারে নেতৃত্ব ধরে রেখেছে। সেপ্টেম্বর মাসে তাদের বিক্রি বেড়েছে মাসওয়ারি ২৬% ও বছরওয়ারি ৭৯%—মোট ৮,৯৯৭ ইউনিট। এর মধ্যে জনপ্রিয় আল্টো মডেলের বিক্রি বেড়েছে ৫০% (বছরওয়ারি) ও ১৩% (মাসওয়ারি)। কাল্টাস, সুইফট ও রাভি মডেলগুলো যথাক্রমে ৭.৩ গুণ, ২.৩ গুণ ও ৪.৩ গুণ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
ইনডাস মোটর কোম্পানি (টয়োটার অ্যাসেম্বলার) বিক্রিতে বছরওয়ারি ৩৩% বৃদ্ধি পেলেও মাসওয়ারি ৭% হ্রাস পেয়েছে—মোট বিক্রি ৩,১৫২ ইউনিট। হ্রাসের কারণ হিসেবে ফর্চুনার ও হাইলাক্স মডেলের কম চাহিদাকে দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে হুন্দাই নিশাতের বিক্রি বেড়েছে বছরওয়ারি ৫৬%, যদিও মাসওয়ারি ৩% কমে দাঁড়িয়েছে ১,১৭৫ ইউনিটে।
সাজগার ইঞ্জিনিয়ারিং (সাজেউ) উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে—তাদের বিক্রি বেড়েছে বছরওয়ারি ৭৩% ও মাসওয়ারি ৩৬% হয়ে ১,৪২৯ ইউনিটে পৌঁছেছে। সম্প্রতি চালু হওয়া হ্যাভাল এইচ৬ পিএইচইভি ভ্যারিয়েন্টের চাহিদা এই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি, যা পাকিস্তানে হাইব্রিড ও প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ির ক্রমবর্ধমান আগ্রহের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাণিজ্যিক যানবাহন ও কৃষিখাতের চিত্র
ট্রাক ও বাস বিক্রি বেড়েছে বছরওয়ারি ২.৬ গুণ ও মাসওয়ারি ২৪%, মোট ৮২৪ ইউনিটে—যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ট্রাক-বাস বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১,৮৬৪ ইউনিট, যা গত বছরের ৯২৬ ইউনিট থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো ও লজিস্টিক খাতে উন্নত কার্যক্রম এই প্রবৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
অন্যদিকে কৃষিখাতে সংকট রয়ে গেছে। ট্রাক্টর বিক্রি কমেছে বছরওয়ারি ২৭% ও মাসওয়ারি ২১%, দাঁড়িয়েছে ৭৯০ ইউনিটে। দুর্বল কৃষি অর্থনীতি ও বন্যাজনিত ক্ষতির কারণে এ মন্দা দেখা দিয়েছে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে ২,০৭৭ ইউনিট ট্রাক্টর উৎপাদন ইঙ্গিত দেয় যে, সরকার কৃষি সহায়তা ও ট্রাক্টর ফাইন্যান্সিং নীতি চালু করলে এই খাতেও পুনরুদ্ধার সম্ভব।
দুই ও তিন চাকার যানবাহন
এই সেগমেন্টেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। মোট বিক্রি বেড়েছে মাসওয়ারি ৭% ও বছরওয়ারি ২১%—মোট ১,৫৮,৯৪১ ইউনিট। অ্যাটলাস হোন্ডা (এটিএলএইচ) তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিক্রি করেছে—১,৩৬,০০০ ইউনিট, যা মাসওয়ারি ৭% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। তবে তিন চাকার যানবাহনের বিক্রি মাসওয়ারি ১৪% হ্রাস পেয়েছে, কারণ কম খরচের মোটরসাইকেল ও নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারণে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
অটো ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ মাশহুদ আলী খান বলেন, “পাকিস্তানের গাড়ি শিল্প ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) মোট বিক্রি ছিল প্রায় ১.৫ লাখ ইউনিট। এই গতিতে চললে চলতি বছরই ২ লাখ ইউনিট ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ব্যবহৃত গাড়ি আমদানি স্থানীয় শিল্পের বড় হুমকি। “যদি প্রতিটি আমদানিকৃত গাড়ির দাম গড়ে ৭,০০০ ডলার হয় এবং আমরা মাসে ১০,০০০ গাড়ি আমদানি করি, তাহলে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাচ্ছে,” বলেন খান। “সরকারের উচিত আমদানি নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা, যাতে স্থানীয় শিল্প রক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ সম্ভব হয়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আজ পাকিস্তানে ১৫টিরও বেশি সক্রিয় অটোমোবাইল কোম্পানি কাজ করছে, যেখানে কয়েক বছর আগেও ছিল মাত্র তিনটি। এই বৈচিত্র্য স্থানীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে—তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারিভাবে নীতি-নিরবিচ্ছিন্নতা ও শিল্পবান্ধব সহায়তা।”