চকচকে জমিদারবাড়ির ভিতরেও ছিল একটি অন্ধকার সংসার—অন্তঃপুর।
যেখানে দিনের আলো পৌঁছাত, কিন্তু নারীর স্বাধীনতা নয়।
এই ছিল সেই ঘর, যেখানে ঠাকুরঝিরা আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতেন আর দাসীরা তাদের রুপোর পানদান বাড়িয়ে ধরত।
এক ঘরে ধর্ম, অন্য ঘরে প্রেম, মাঝে জড়িয়ে থাকত শরীর আর নিঃসঙ্গতা।
পুরুষ শাসিত বাহ্যিক রাজত্বের আড়ালে নারীদের এই গোপন সংসার ছিল ভালবাসা, হাহাকার, বেদনা ও আকাঙ্ক্ষার এক অদৃশ্য রাজ্য।
‘অন্তঃপুর’ সিরিজে আমরা প্রবেশ করব সেই নিষিদ্ধ অন্দরমহলে—
যেখানে নারীরা ছিলেন পরিচয়হীন, কণ্ঠহীন, অথচ প্রতিদিন যুদ্ধ করতেন আত্মা ও শরীরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
আমিরুল মোমেনিন:
জমিদারবাড়ির কথা উঠলেই চোখে ভাসে পিরিচে চা, লাল আলতা, আতরের শিশি আর কাঁচের জানালায় সূর্যছায়া। কিন্তু সেই আলোচকচকে আয়নার পেছনে ছিল এক স্তব্ধ, অস্পষ্ট জগৎ অন্দরমহল। নারীদের জন্য নির্ধারিত সেই গণ্ডির ভেতরেই বাস করতেন ঠাকুরঝি, বড়বউ, কনেবউ, দাসী, হেঁশেলের মেয়ে কিংবা নিঃশব্দ গোপনপ্রেমিকা নাম ছিল না, ছিল শুধু পরিচয়ের ছায়া।
এই নারীদের সকাল হতো নির্ধারিত বাড়ির ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতেন তাঁরা। মুখ ধুয়ে ভেজা কপালে সিঁদুর, ঠাকুরঘরে প্রদীপ, তারপর রান্নাঘরের দিকে হাঁটা। কেউ আয়নার সামনে বসে কেশ বিন্যাস করছেন, কেউ পানদান খুলে রুপোর পাতায় চুন মাখাচ্ছেন। অথচ ভিতরে ভিতরে জমে থাকত দগদগে কিছু ভালোবাসার ক্ষুধা, শরীরের তৃষ্ণা, অথবা শুধু কথা বলার আকাঙ্ক্ষা।
প্রতিটি জমিদারবাড়িতেই ‘অন্দরমহল’ ছিল এক অদৃশ্য গৃহবন্দিত্ব। পুরুষ প্রবেশাধিকারহীন সে জগৎ কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক শাসনের নিঃশব্দ সীমানা। নারী সেখানে দুই রকম প্রধান পত্নী আর দাসী। প্রধান পত্নী মানে রাজনীতির ছায়াপথে চলা এক নিঃসঙ্গ রাণী, আর দাসী মানে কাজের বিনিময়ে নিজের অস্তিত্ব হারানো এক জীবন্ত শরীর। উভয়েই নিয়ন্ত্রণের শেকলে বাঁধা।
একবার বাড়ির গুরুজিকে ভেতরবাড়ি যেতে দেখে কানে কানে বলেছিল রাধা দাসী, “বড়বউয়ের মাথাব্যথা কি এখন গুরুজিই সারাচ্ছেন?” এই রসিকতায় ছিল বিষ। কারণ, অন্দরমহলে সম্পর্কগুলো ছিল রক্তের মতো গাঢ়, আবার জলের মতো গোপন। প্রেম এসেছিল কখনও সেপাইবাবুর চোখে, কখনও রাঁধুনির ভাইয়ের হাতে লেখা চিঠিতে, কখনও কেবল দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দেওয়া একটা পান।
একজন বড়বউ নাকি একটানা বিশ বছর একই ঘরে থেকেছেন শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে পৃথিবী দেখতেন। আর এক দাসী, যার কথা কেউ মুখে আনত না, সে মাঝরাতে রান্নাঘরের আড়ালে কারো স্পর্শে কেঁপে উঠত।
এই ছিল সেই সংসার—চকমকে আয়নার পেছনের স্তব্ধ সংসার। এখানে প্রেম ছিল না, ছিল তৃষ্ণা; কথা ছিল না, ছিল নিঃশ্বাস। বাইরে থাকত খইয়ের হাঁড়ি, পায়রার শব্দ, আতরের গন্ধ। আর ভিতরে এক বিশাল স্তব্ধতা, যা কেউ কখনো জোরে বলেনি, তবে সবাই টের পেত।
পরবর্তী পর্বে:
ঠাকুরঝি ও দাসী—আত্মা ও শরীরের লড়াই
(যেখানে খোলস ভাঙে, মুখ খুলে অনুভব, এবং প্রথম চুম্বনের ভয় ছায়া হয়ে হাঁটে।)