Home আন্তর্জাতিক ক্ষুধায় কঙ্কালসার রো’য়া: গাজার মায়ের অসহায় আর্তনাদ

ক্ষুধায় কঙ্কালসার রো’য়া: গাজার মায়ের অসহায় আর্তনাদ

সংগৃহীত ছবি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গাজার নাসের হাসপাতালে সাদা চাদরে ঢাকা টেবিলে পড়ে আছে দুই বছর ছয় মাস বয়সী রো’য়া মাশির নিথর দেহ। ক্ষীণ হাত, বেরিয়ে আসা পাঁজর আর ডুবে যাওয়া চোখ যেন যুদ্ধ আর ক্ষুধার নীরব সাক্ষ্য হয়ে আছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তার কোনো পূর্বের রোগ ছিল না। কেবল মাসের পর মাস খাদ্যসংকট আর চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার কারণে ছোট্ট শরীরটি হাড়সার হয়ে গিয়েছিল।

রো’য়া ছিল গত দুই সপ্তাহে নাসের হাসপাতালে অপুষ্টিতে মারা যাওয়া চার শিশুর একজন। তার মা ফাতমা মাশি জানালেন, গত বছর থেকেই মেয়ে ওজন হারাতে শুরু করেছিল। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন দাঁত ওঠার কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু অক্টোবরে যখন রো’য়াকে হাসপাতালে নেন, তখনই জানা যায় তার শরীর গুরুতরভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে।

ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে বারবার ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়া, চিকিৎসা বিঘ্নিত হওয়া এবং প্রতিদিন কেবল একবেলা সেদ্ধ ম্যাকারনি খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা—এসবই ধীরে ধীরে শেষ করে দিয়েছে রো’য়ার জীবন। মায়ের কণ্ঠে কান্না মিশে ছিল যখন তিনি বললেন, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আর দু-তিন দিনের মধ্যেই কিছু একটা হবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশ্য ক্ষুধার বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ক্ষুধা নেই, কখনো ছিল না, এবং কোনোভাবেই ক্ষুধার নীতি প্রয়োগ করা হয়নি। তার দাবি, আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা আসলে হামাসের প্রচারিত মিথ্যা।

কিন্তু জাতিসংঘের তথ্য একেবারে ভিন্ন ছবি দেখাচ্ছে। শুধু জুলাই মাসেই গাজার পাঁচ বছরের নিচের প্রায় বারো হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে আড়াই হাজারেরও বেশি শিশুর অবস্থা ছিল জীবনসংকটাপন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও অনেক বেশি হতে পারে।

অবশেষে দীর্ঘ দুই মাসের কড়াকড়ি শেষে ইসরায়েল খাদ্য আমদানির মাত্রা কিছুটা বাড়িয়েছে। তবুও বাজারে দাম এখনো আগের চেয়ে অনেক বেশি, যা অধিকাংশ পরিবারের নাগালের বাইরে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সাধারণ খাদ্য সরবরাহ দিয়েই শিশুদের বাঁচানো সম্ভব নয়। গুরুতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি বিশেষ পুষ্টি উপাদান ও চিকিৎসা-ভিত্তিক খাদ্য দরকার। নইলে হঠাৎ খাওয়ালে তা শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জুলাইয়ের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত কারণে ৪২ শিশু ও ১২৯ প্রাপ্তবয়স্ক মারা গেছে। যুদ্ধের শুরু থেকে ক্ষুধায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০৬ শিশু। নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ২০ জন শিশু গুরুতর অপুষ্টি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে।

পাঁচ বছরের জামাল আল-নাজ্জার রিকেটসে আক্রান্ত। তার ওজন ১৬ কেজি থেকে নেমে এসেছে মাত্র ৭ কেজিতে। হাড়সার শরীরের দিকে তাকিয়ে তার বাবা বলেছেন, অবশ্যই এখানে দুর্ভিক্ষ চলছে। দুই বছরের শাম্ম কুদেইহের ওজন মাত্র ৪ কেজি। এক বিরল রোগে আক্রান্ত হলেও যথাযথ খাদ্য পেলে তার জীবন বাঁচানো সম্ভব। অবশেষে দীর্ঘ দেরির পর তাকে চিকিৎসার জন্য ইতালিতে নেওয়া গেছে।

চিকিৎসকেরা সতর্ক করেছেন, ১৮ মাস থেকে দুই বছরের শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সামান্য সংক্রমণ, স্বাভাবিক অসুখ কিংবা খাবারের ঘাটতিই তাদের দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

গাজায় আসন্ন সামরিক অভিযান নতুন করে আরও বাস্তুচ্যুতি আর খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করার আশঙ্কা তৈরি করছে। চিকিৎসকেরা সতর্ক করছেন, অবিলম্বে সঠিক চিকিৎসা, ভিটামিন-খনিজ সাপ্লিমেন্ট ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা না হলে মৃত্যুর এই মিছিল থামানো যাবে না। ছোট্ট রো’য়ার নিথর দেহ যেন সেই আশঙ্কারই প্রতীক হয়ে রইল।


আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন, যাতে পৃথিবী জানতে পারে গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়ের কথা।