Home First Lead মহাসড়কে যাত্রাবিরতি: চাকচিক্যের আড়ালে অস্বাস্থ্যকর খাবার আর গলাকাটা দামের ফাঁদ

মহাসড়কে যাত্রাবিরতি: চাকচিক্যের আড়ালে অস্বাস্থ্যকর খাবার আর গলাকাটা দামের ফাঁদ

মিষ্টি তৈরির প্রস্তুতি চলছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খালি হাতেই ছানা প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে, যা পরবর্তীতে যাত্রীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হবে।

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। এই পথ ধরে প্রতিদিন ছুটে চলে হাজারো যানবাহন, যাতায়াত করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে একটু স্বস্তি পেতে যাত্রীরা যখন সড়কের পাশে ঝলমলে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে থামেন, তখন তাদের জন্য অপেক্ষা করে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর খাবার, গলাকাটা দাম এবং যাত্রী হয়রানির এক সংগঠিত ফাঁদ।

সরেজমিনে যা দেখা গেল

সম্প্রতি কুমিল্লার মহাসড়ক সংলগ্ন চৌদ্দগ্রামের একটি নামকরা হোটেলের পেছনের অংশে গিয়ে যা দেখা গেল, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। হোটেলের পেছনে স্যাঁতস্যাঁতে, কর্দমাক্ত মাটির ওপর একটি পুরোনো পাটি বিছিয়ে চলছে মুরগি কাটার কাজ। কাটা মুরগির রক্ত, নাড়িভুঁড়ি আর আবর্জনার স্তূপের চারপাশে ভনভন করছে অসংখ্য মাছি। পাশেই কয়েকটি বালতিতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে কাটা মাংস।

যেখানে এই মাংস ধোয়া হচ্ছে, সেই স্থানের চিত্র আরও জঘন্য। শ্যাওলা পড়া একটি পুরোনো চৌবাচ্চার পাশে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চলছে ধোয়ার কাজ। সেই পানি নিষ্কাশনেরও কোনো সুব্যবস্থা নেই, যা পরিবেশকে আরও দূষিত করছে। এখান থেকেই মাংস সরাসরি চলে যাচ্ছে হোটেলের রান্নাঘরে। ভেতরের রান্নাঘরের অবস্থাও তথৈবচ—তেল চিটচিটে দেয়াল, ময়লা মেঝে আর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে চলছে হাজারো যাত্রীর জন্য খাবার তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। একই স্থানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে কুমিল্লার বিখ্যাত মিষ্টির নামে ভেজাল মিষ্টান্ন।

যাত্রীদের দুর্ভোগ ও হোটেল-বাস সিন্ডিকেট

এই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রীরা এই পরিস্থিতিকে এককথায় “জিম্মিদশা” বলে অভিহিত করেছেন। চট্টগ্রামের যাত্রী আবদুল মতিন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “হোটেলের বাইরের চাকচিক্যে ঢুকে দেখি ময়লার দুর্গন্ধ, মশার ঝাঁক, আর তেলচিটচিটে পরিবেশ। বাধ্য হয়েই খেতে হয়। একবার খেলে আবার আসার সাহস থাকে না, কিন্তু পরের বার বাস তো এখানেই থামায়।”

এর পেছনের কারণ হলো হোটেল মালিক ও বাস চালকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। দাউদকান্দি, চান্দিনা, বুড়িচং, সদর দক্ষিণসহ কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা এসব রেস্তোরাঁর সঙ্গে অধিকাংশ বাস কর্তৃপক্ষের গোপন চুক্তি রয়েছে। প্রতিটি বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার নির্ধারিত হোটেলে যাত্রী নামানোর বিনিময়ে বিনামূল্যে খাবার এবং ট্রিপ প্রতি মোটা অঙ্কের কমিশন পান।

শ্যাওলা পড়া একটি পুরোনো চৌবাচ্চার পাশে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চলছে মুরগির মাংস ধোয়ার কাজ। খাবারের মান ও যাত্রীদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীনতার এক স্পষ্ট চিত্র।

আরেকজন যাত্রী বলেন, “এটা পুরোটাই ডাকাতি। যে পরোটার দাম পাঁচ টাকা, সেটার দাম রাখে ২০ টাকা। ১০ টাকার এক কাপ চা বিক্রি করে ৩০ টাকায়! আমরা অভিযোগ করলেও ড্রাইভাররা শোনে না, বলে কোম্পানির নির্দেশ। এই পচা-বাসি খাবার চড়া দামে খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না।”

প্রশাসনের উদাসীনতা ও প্রভাবহীন অভিযান

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, গত তিন বছরে শুধু হাইওয়ের কুমিল্লা অংশেই অন্তত ৫০টির বেশি হোটেল ও রেস্তোরাঁকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং পচা-বাসি খাবার বিক্রির দায়ে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু জরিমানা গুনেই আবার পুরনো চেহারায় ফিরে যায় প্রতিষ্ঠানগুলো। লোক দেখানো এসব অভিযানে পরিস্থিতির কোনো স্থায়ী উন্নতি হয়নি।

এই অনিয়ম আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শুধু সাধারণ যাত্রীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিই তৈরি করছে না, বরং দেশের পর্যটন ও পরিবহন ব্যবস্থার সুনামকেও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এই মহাসড়ক দিয়েই প্রতিদিন কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটির মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে হাজারো পর্যটক যাতায়াত করেন।

নিয়ন্ত্রণের অভাবে যাত্রাবিরতির এই রেস্তোরাঁগুলো এখন আর সেবাকেন্দ্র নয়, বরং যাত্রী হয়রানির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই চক্র ভাঙতে এবং যাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কঠোর মনিটরিং, ভোক্তা অধিকার আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

📌 সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব—প্রতিবেদনটি শেয়ার করে সবাইকে জানাতে সাহায্য করুন।