হেলথ ডেস্ক:সন্তান মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতার প্রতীক। কিন্তু অনেক দম্পতির কাছে এই পরিপূর্ণতা দীর্ঘ অপেক্ষা, চিকিৎসা ও হতাশার মধ্য দিয়ে আসে। আজকের যুগে সন্তানহীনতা আর নিছক নিয়তির বিষয় নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) বা ‘টেস্ট টিউব বেবি’ পদ্ধতি সন্তান লাভের নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে এই প্রযুক্তি যেমন আশার আলো, তেমনি রয়েছে সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক অনেক চ্যালেঞ্জ।
আইভিএফ কী?
আইভিএফ হলো এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে নারী ও পুরুষের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু শরীরের বাইরে বিশেষ ল্যাবরেটরিতে নিষিক্ত করা হয়। সফল নিষিক্তকরণের পর ভ্রূণকে নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। সাধারণত সন্তান ধারণে বারবার ব্যর্থতা, বন্ধ্যাত্ব, বয়সজনিত সমস্যা কিংবা পুরুষের শুক্রাণুর অক্ষমতা থাকলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
কারা উপকৃত হন এই পদ্ধতি থেকে?
আইভিএফ মূলত তাদের জন্য, যারা প্রাকৃতিকভাবে সন্তান ধারণে অক্ষম। যেমন:
- ডিম্বাণু নিষ্ক্রমণজনিত জটিলতা
- শুক্রাণুর অপ্রতুলতা বা গুণগত মানের সমস্যা
- জরায়ুর জটিলতা
- ফ্যালোপিয়ান টিউব অবরুদ্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত
- বয়স ৩৫ এর বেশি নারীদের ক্ষেত্রে
অনেক সময় আইভিএফই হয়ে ওঠে সন্তান লাভের একমাত্র ভরসা।
প্রক্রিয়া কীভাবে চলে?
১. হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে নারীর শরীরে একাধিক ডিম্বাণু উৎপাদনে উদ্দীপনা দেওয়া হয়।
২. সময়মতো ডিম্বাণু সংগ্রহ করে শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করা হয়।
৩. ল্যাবরেটরিতে ভ্রূণ তৈরি হলে তা নারীর জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।
৪. কিছুদিন পর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া হয় ভ্রূণটি গর্ভে স্থায়ী হয়েছে কিনা।
সফলতার হার ও চ্যালেঞ্জ
সফলতার হার বয়স ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন হয়। ৩০ বছরের নিচে নারীদের ক্ষেত্রে IVF সফলতার হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমে আসে।
এ ছাড়া রয়েছে মানসিক চাপ, চিকিৎসার দীর্ঘ সময়, আর্থিক ব্যয় এবং একাধিকবার প্রক্রিয়া চালানোর প্রয়োজনীয়তা। অনেক সময় সন্তান না এলে দাম্পত্য সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও মানসিক দিক
বাংলাদেশের মতো সমাজে আইভিএফ পদ্ধতিকে এখনো অনেকেই গোপন রাখেন। কারণ রয়েছে কুসংস্কার, ভুল ধারণা এবং ‘টেস্ট টিউব বেবি’ নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব। অথচ এ শিশুর জন্মও অন্য দশজন শিশুর মতোই স্বাভাবিক।
আইভিএফ দম্পতিদের জন্য মানসিক পরামর্শ, পারিবারিক সমর্থন এবং সঠিক তথ্যভিত্তিক বোঝাপড়া অত্যন্ত জরুরি।
আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন
অনেক দেশে আইভিএফ চিকিৎসা নিয়ে আইনি কাঠামো রয়েছে, যেমন ভ্রূণ সংরক্ষণ, দাতা শুক্রাণু ব্যবহার, বহুব্যবহার ইত্যাদি। বাংলাদেশে এখনো এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রয়োজন।
আইভিএফ নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী চিকিৎসা পদ্ধতি, যা অগণিত দম্পতির জীবনে নতুন আশা জাগিয়েছে। তবে এটি যেন শুধু চিকিৎসা নয়, বরং এক মানসিক যাত্রা যেখানে প্রয়োজন ধৈর্য, তথ্য, সহমর্মিতা এবং সামাজিক সচেতনতা।
সম্ভাবনার মতো করুণ বাস্তবতাও রয়েছে
IVF পদ্ধতি যেমন অনেকের কাছে নতুন জীবনের আশার বাতিঘর, তেমনি কিছু বাস্তবতা হৃদয়বিদারক। অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী সম্ভাবনা শেঠের অভিজ্ঞতা তারই প্রমাণ। বহু বছর ধরে মা হওয়ার চেষ্টা করে অবশেষে তিনি আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তান ধারণ করেন। গর্ভে সন্তান বেড়ে উঠছিল, এমনকি মাতৃত্বকালীন ফটোশ্যুটও করেছিলেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ বিপুল রক্তক্ষরণ শুরু হয়। হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, ১৫ দিন আগেই গর্ভে থাকা সন্তানটি মারা গেছে। অথচ এই সময়টায় তিনি চিকিৎসকের আশ্বাসে স্বস্তিতে ছিলেন।
সম্ভাবনার অভিযোগ, বারবার রক্তপাত হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসক তার অভিযোগকে গুরুত্ব দেননি। বরং প্রতিবারই শুধু ‘সব ঠিক আছে’ বলেই এড়িয়ে গিয়েছেন। অভিনেত্রীর ভাষায়, ‘‘আইভিএফে এত রক্তপাত হয়, আমার জানা ছিল না। চিকিৎসকের গাফিলতিতেই আমি মা হতে পারিনি।’’
এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, শুধু প্রযুক্তির উপর নির্ভর করলেই হবে না—চিকিৎসা-পর্যবেক্ষণের গুণগত মান, মানবিক মনোযোগ এবং রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রতি সজাগ দৃষ্টি জরুরি। IVF প্রক্রিয়া চলাকালে নারীর শরীর যে জটিলতার মধ্যে দিয়ে যায়, তা বুঝে প্রতিটি ধাপেই চিকিৎসকদের যত্নবান হওয়া দরকার।